>> কালীগঞ্জের কৃষকের সম্বল ভিজছে মাঠে মাঠে
সাবজাল হোসেন,বিশেষ প্রতিনিধি ॥
এই তো সেদিন আগাম পাকা আমন ধানের ক্ষেত দেখেছিল নি¤œচাপের বৃষ্টির নিষ্ঠুরত। অসময়ের বৃষ্টিতে পঁচে গলে নষ্ট হয়েছিল আগাম আমন ধান। এরপর কৃষকেরা তাকিয়েছিলেন আমনের নাবী ধানের দিকে। কিন্ত চলমান নি¤œচাপের প্রভাবের বৃষ্টিতে সেই নাবি ক্ষেতও আজ ক্ষতির সম্মুখীন। দফায় দফায় প্রকৃতির এমন খামখেয়ালীতে এ বছর আমন চাষীরা পড়েছেন চরম বিপাকে।
কৃষি অফিস বলছে,এ বছরের বৈরি আবহাওয়ায় বৃষ্টিতে আগাম আমনে চোট খেয়েছিল কৃষক। নাবিতেও সেই বৈরি আবহাওয়া চোখ রাঙাচ্ছে। তবে শেষ মুহুর্তের এ সময়ে এসে যদি আগামী দুই একদিনের মধ্যে বৃষ্টি কেটে যায় তাহলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না। এর আগে আগাম ধানে বেশ ক্ষতি হলেও কৃষকেরা তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেছিলেন।
তবে কৃষকেরা বলছেন, এ আমন মৌসুমে আমরা দেখলাম প্রকৃতির র্নিমমতা। তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার শুরু হয়েছে ধানের উপরের বুষ্টির ধবংসলীলা। গত দুইদিন ধরে বৃষ্টির ফোটা বন্ধই হচ্ছেনা। এমন অবস্থায় মাঠের সব ধান ভিজে একাকার হয়ে গেছে। আবার নিচু ক্ষেতগুলোতে পানি জমতে শুরু করেছে। ধারনা তাড়াতাড়ি প্রকৃতি সহনশীল হয়ে বৃষ্টি বন্ধ না হলে এবছরের আমন নিয়ে আশার গুড়ে বালি হবে কৃষকদের।
সরেজমিনে বুধবার ছিটেছাটা বৃষ্টি শুরু হলে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বিভিন্ন মাঠে গেলে দেখা যায়,মাঠের পর মাঠে আমন ধান ক্ষেতেই পড়ে ভিজছে। তারমধ্যে কোনটি ক্ষেতে ছড়ানো,কোনটি আটি বাধা,আবার কোনটি না বাধা ধান জমিতে ছড়ানো ছেটানো। এগুলোর ওপর দিয়ে গত ২ দিনে বয়ে যাচ্ছে লাগাতর বৃষ্টি। এ মৌসুমের ২য় বারের মত এমন অবস্থার জন্য মনে হচ্ছে এবছরের আমন নিয়ে কৃষকদের ঝামেলা যেন কোনভাবেই পিছু ছাড়ছে না।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানাগেছে, চলতি আমন মৌসুমে এ উপজেলার ধানচাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৫’শ হেক্টোর। কিন্ত চাষ হয়েছে ১৮ হাজার ৭’শ ৫০ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২’শ ৫০ হেক্টর বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ জমির ধান কৃষকেরা ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকি ধানের ১০ ভাগ মত বাড়িতে এনে পালা দিয়ে রেখেছেন আর গুলো ক্ষেতেই পড়ে ভিজছে।
একাধিক কৃষক জানান, চলতি আমন মৌসুমের ধানে কোন ধরনের কীটপতঙ্গের আক্রমন ছিল না। ইতোমধ্যে যে ধানগুলো মাড়াই করা হয়েছে ফলনও হয়েছে লোভনীয়। ফলে ক্ষেতের ধান কৃষকদেরকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। কিন্ত পরপর দ’ুদফার নি¤œচাপের বৃষ্টিতে কৃষকের আমন ধানে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে।
তারা আরও জানান,গত বছর এমন সময়ে ঝড়োবৃষ্টিতে ধানের মহা সর্বনাশ হয়েছিল। এ বছরও প্রকৃতির সেই কালো থাবায় জর্জরিত হতে বসেছে কৃষকেরা। এমন অবস্থায় বৃষ্টি থেমে গেলেও ধান বাঁচাতে শুরু হবে শ্রমিক নিয়ে কাড়াকাড়ি। অপেক্ষাকৃত বেশি মুজুরী হাঁকিয়ে প্রতিযোগীতার ভিত্তিতে কৃষি শ্রমিক আয়ত্বে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রেও উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এখন তাদেও ভাবনা কতদিন চলবে এ বেরসিক বৃষ্টি, সে সময় পর্যন্ত ধানের কি পরিমান ক্ষতি হবে, পরে সহজেই শ্রমিক মিলবে কিনা আমন নিয়ে এমন নানা ভাবনায় আছেন তারা।
কালীগঞ্জ উপজেলার খেদাপাড়া (ঘোষপাড়া) গ্রামের কৃষক নৃপেন্দ্রনাথ ঘোষ জানান, প্রথম যখন আগাম আমন ধান কেটেছিলাম তখনও বৃষ্টিতে ধান কলিয়ে ক্ষেতেই নষ্ট হয়েছিল। আবার নাবি ধান কেটেছি এর পরের দিন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সকালে দেখলাম ক্ষেতে কেটে ফেলিয়ে রাখা ধান পানিতে একাকার হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টি না থামলে ক্ষেতেই পঁচে নষ্ট হবে। আর আবহাওয়া অনুকুলে আসলেও ফলনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এখন খুব চিন্তায় আছি।
উপজেলার খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক শাহাজান আলী জানান, এ বছর ৫ বিঘা জমিতে আমনের চাষ করেছিলাম। আগে ২ বিঘা জমির ধান বাড়িতে এনে মাড়াই শেষ করেছি। বেশ ভালো ফলন হয়েছে। মাঠে আরও যে ক্ষেতগুলো রয়েছে সে গুলোর ধান আরও বেশি ভালো ছিল। তার মধ্যে গতকাল গরুর গাড়িতে করে একবিঘা জমির ধান তড়িঘড়ি মাঠ থেকে বাড়ি এনেছি ঠিকই কিন্ত শ্রমিক না পাওয়ায় নিজের ব্যস্ততায় পালা দিতে পারিনি। এরমধ্যে লাগাতর বৃষ্টি শুরু হয়েছে এখন বাড়ির এবং মাঠের সব ধানই লাগাতরভাবে ভিজছে।
ঘোপ গ্রামের কৃষক রেজাউল মালিতা জানান, এ বছর আমন নিয়ে ঝামেলা যেন পিছু ছাড়ছে না। কয়েকদিন আগে নি¤œচাপে ক্ষেতের ধান পঁচেছে। আবার শুরু হয়েছে নি¤œচাপের প্রভাবে লাগাতর বৃষ্টি। এটা কেটে গেলেও কৃষকের আমন নিয়ে ভোগান্তি যেন কোন ভাবেই কাটছে না। তিনি আরও বলেন, এ বছর সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিলাম। এজন্য সারা আমন মৌসুম পরিচর্যায় টাকা ব্যয় করেছি। ক্ষেতে ধান হয়েছিল ছিল বেশ। কিন্ত ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেলো। এমনিতে শীতের হিমশীতল আবহাওয়া এরমধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করাও যাচ্ছে না। আর সে কারনেই কৃষি শ্রমিক ঠিকমত পাওয়া যাবে না। আবার ভিজে ধান ক্ষেতে রাখাও যাবে না। শ্রমিক পাওয়া গেলেও ভেজা ধানে একদিকে বেশি শ্রমিক লাগবে আবার মুজুরীও বেশি গুনতে হবে। নি¤œচাপের বৈরি আবহাওয়ায় একদিকে ফলন কমে যাবে। অন্যদিকে কৃষি শ্রমিকের দিতে হবে কয়েকগুন বেশি টাকা লাগায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খন্দকার মোহায়মেন আক্তার জানান, চলতি আমন মৌসুমের শুরু থেকে কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মিসহ সকল স্তরের কর্মকর্তারা প্রচন্ড পরিশ্রম করে কৃষকদেরকে নানা দিক নির্দেশনা দিয়ে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত কৃষকেরা যে পরিমান ধান ঘরে উঠাতে পেরেছেন ফলন খুবই ভালো হচ্ছে। মাঠের বাকি ধান কৃষকেরা ঠিকমত ঘরে তুলতে পারলে মনে রাখার মত ফলন পাবেন । কিন্ত চলমান বৈরি আবহাওয়ায় শেষ মুহুর্তেও আমনের ব্যাপক ক্ষতি হলো। কিন্ত প্রকৃতিতে কারও হাত নেই।