কুয়েট শিক্ষকের মৃত্যু: ছাত্ররা ধরে নিয়ে গেছে, দায়িত্বই ছেড়ে দেবো’

9
অধ্যাপক সেলিম হোসেন ও তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা। ছবিটি এখন শুধুই স্মৃতি-খুলনাঞ্চল
Spread the love

স্টাফ রিপোর্টার ।।

সেদিন মুখে হাসি নিয়েই কুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন (৩৮)তবে বাসায় ফিরেছেন ‘বিধ্বস্ত’ হয়ে—এমনটাই জানিয়েছেন মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) মারা যাওয়া কুয়েট শিক্ষকের স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা।

তিনি বলেন, ‘‘বাসায় ফিরে বললো, ‘ছাত্ররা ধরে নিয়ে গেছে। দায়িত্বই ছেড়ে দেবো।’ আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। হত্যায় জড়িতদের ফাঁসি চাই। ছয় বছরের মেয়েকে এতিম আমাকে স্বামীহারা করলো। আমি আমার মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই।’’

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে সাবিনা খাতুন রিক্তা জানান, ৩০ নভেম্বর সকালে তার স্বামী হাসি মনে কুয়েটে যান। আর দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে বাসায় আসেন। তখন তাকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। বাসায় এসেই স্ত্রীকে বললেন ছাত্ররা তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা। দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলেও জানালেন। তখন তার চোখ-মুখ খুব খারাপ অবস্থা দেখাচ্ছিল। এরপর তিনি গোসল করতে বাথরুমে ঢোকেন। কিন্তু বের হতে দেরি হলে তিনি দরজায় নক করেন, কিন্তু কোনও সাড়া না পেয়ে চিন্তায় পড়েন।

সাবিনা বলেন, ‘চিন্তা বাড়লে চিল্লাপাল্লা করি। তখন আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। এরপর বাথরুমের দরজা ভেঙে তাকে বসা অবস্থায় দেখি। কিন্তু চোখ বন্ধ। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। মুখে পানি ছিটা দিলে চোখ খোলে। কিন্তু কথা বলতে পারেনি। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘ছয় বছরের প্রেম ছিল আমাদের। তারপর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। এরপর কেটে গেছে আরও ১০ বছর। সংসারের কোনও কাজই তাকে বলা লাগতো না। বাসায় রাতের মশারিও নিজে টানাতো। বাসায় থাকাকালে আমাকে কোনও কাজ করতে দিতো না। চাকরিতে চলে গেলেও বাসার খোঁজ রাখতো সবসময়। সেই মানুষটার এমন মৃত্যু আমি সইতে পারছি না। আট বছর আগে পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আমাকে সঙ্গে নিয়েই যায়। সেখানে চার বছর থাকার পর দেশে ফিরে এসে কুয়েটে যোগ দেয়। করোনার মধ্যে প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পায়। একইসঙ্গে হলের প্রভোস্ট হয়।’

স্বামী হারানো সাবিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘কুয়েট কর্তৃপক্ষ ঘটনা নিয়ে মামলা না করলে আমি নিজেই বাদী হয়ে মামলা করবো। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাইবো। আমার মেয়েকে এতিম করা হয়েছে। জড়িতদের ফাঁসি চাই। ক্ষতিপূরণ চাই।’

কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘সেলিমের মৃত্যুর পর সাধারণ সভা করে আমরা ঘটনায় দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে কুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি শিক্ষক সেলিমের নিয়মিত পাওনার বাইরে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অতিরিক্ত এক কোটি টাকা পরিবারকে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।’

শিক্ষক ছাত্রদের অভিযোগে জানা গেছে, ৩০ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বাধীন ছাত্ররা ক্যাম্পাসের রাস্তা থেকে ড. সেলিম হোসেনকে জেরা করা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা আনুমানিক আধঘণ্টা ওই শিক্ষকের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। পরে ড. সেলিম হোসেন দুপুরে খাবারের উদ্দেশে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বাসায় যান। বেলা ২টার দিকে তার স্ত্রী লক্ষ করেন তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। পরে তিনি দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করেন এবং খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেন। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সাদমান নাহিয়ান সেজান শুক্রবার (ডিসেম্বর) খুলনা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ‘অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। যা রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করে সাধারণ ছাত্র ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।’

তার দাবি, ‘‘শিক্ষক সেলিম হোসেন ১১ মাস আগে কুয়েটের লালন শাহ হলের দায়িত্ব পান। হলগুলোতে যখনই নতুন প্রভোস্ট নিয়োগপ্রাপ্ত হন, ছাত্রকল্যাণ কমিটির পক্ষ থেকে প্রভোস্টের সঙ্গে হলের ফাইনাল ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। যেন হলের বিভিন্ন কর্মসূচি, অ্যানুয়াল ফিস্ট, ক্রীড়া অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবস উদযাপন এবং সার্বিক কর্মকাণ্ড ছাত্র-শিক্ষক সমন্বয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়। সেই কারণে, ৩০ নভেম্বর দুপুর ১২টায় প্রভোস্ট নিজ অফিস কক্ষে একটি মিটিং নির্ধারণ করেন। শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম শেষ করে পূর্ব নির্ধারিত মিটিংয়ে যোগ দিতে আনুমানিক ৪০ মিনিট বিলম্ব হয়। ঘটনাক্রমে আমাদের দেরি হওয়ায় পথে স্যারের সঙ্গে দেখা হয় এবং তিনি বলেন, ‘তোমরা এখন আসছো? আমি তো বের হয়ে আসছি।’ তারপর আমাদের বিলম্বের কারণ জানালে স্যারই তার কক্ষে আসতে বলেন। এরপর স্যার তার কক্ষের তালা খুললে শিক্ষার্থীরা তার অনুমতি নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করে। সব শিক্ষার্থীর আসন সংকুলান না হওয়ায় স্যার সিনিয়রদের ভেতরে বসতে এবং জুনিয়রদের কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন। সিনিয়রদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর স্যার বাইরে অপেক্ষমাণ ছাত্রদের ডাকেন এবং বলেন, ‘আমার তো আড়াইটায় ল্যাব আছে, আমি সন্ধ্যায় হলে গেলে তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হবো।’ এরপর স্যার সবাইকে চা অফার করেন, কিন্তু পর্যাপ্ত কাপ না থাকায় এবং লাঞ্চ আওয়ার চলায়, স্যারের অসুবিধার কথা ভেবে শিক্ষার্থীরা তখন কিছু না খেয়ে হলে ডাইনিং করার কথা জানায়।’’

ছাত্রলীগের এই নেতা আরও বলেন, ‘তখন স্যার রুমের দরজার পাশে থাকা টেবিলে এক বোতল মধু দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে মধু খেয়ে যেতে বলেন। তখন জুনিয়র শিক্ষার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করে মধু খায় এবং রুম থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়। এরপর সিনিয়ররাও স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে রুম থেকে বের হয়। এর ঘণ্টাখানেক পর দুপুরে স্যারের অসুস্থতার সংবাদ পাওয়া মাত্র হলে থাকা ছাত্ররা সিটি মেডিক্যালে যায় এবং সেখানে গিয়ে জানতে পারে তিনি নিজ বাসায় স্ট্রোক করেছিলেন এবং তখন তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুয়েট মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিটি মেডিক্যালে রেফার করেন। কিন্তু সিটি মেডিক্যালের ডাক্তাররা জানান, পথিমধ্যেই তিনি মারা গেছেন। এরপর স্যারের লাশ নিয়ে খুলনা মেডিক্যালে গিয়ে মৃত্যুসনদ সংগ্রহ করা হয়, যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্ট্রোকের কথা উল্লেখ ছিল। এরপর স্যারের লাশ ক্যাম্পাসে পৌঁছালে অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী গুণগ্রাহী তার জানাজায় শরিক হন। তার লাশ দাফনের উদ্দেশে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে তার পরিবার-পরিজন, সহকর্মী শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।’

সাদমান নাহিয়ান সেজান আরও বলেন, ‘তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই একটি কুচক্রী মহল সাধারণ শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে ন্যক্কারজনক রাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছে। কোনও তথ্যপ্রমাণ ছাড়া প্রাণপ্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার যোগসূত্র ঘটিয়ে আমাদের যে মানসিক ট্রমার মধ্যে ধাবিত করেছে, যা এক কথায় জঘন্য এবং ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের শামিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা এবং ঘৃণা জানাচ্ছি।’ একইসঙ্গে তথ্য-প্রমাণ ব্যতিরেকে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ জানান।