নারীর ক্ষমতায়ন ও অভিবাসন

1
Spread the love

                               — নাহিদ আলম

একটা  সময় ছিল যখন নারীর কাজকর্ম বলতে গৃহস্থালীর কাজকর্মকেই বুঝানো হতো। যেমন- ঘরকন্যার কাজ। বাসা বাড়ি পরিস্কার করা, রান্না-বান্না, সন্তান লালন-পালন করা ইত্যাদি। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। বর্তমানে নারী দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও নানা ধরনের কাজকর্মে নিয়োজিত হচ্ছে। তাদের কাষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়ে দেশে থাকা বাবা-মা, ভাই-বোনদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। সেই সাথে সমৃদ্ধ করছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ভান্ডারকে, যা প্রতিমাসেই নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে।

এরকমই একজন অভিবাসী নারী মাকসুদা। পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ায় সংসারে সচ্ছলতা আনতে ঢাকায় আসে এইচএসসি পাস করার পর। এসে গার্মেন্টেসে কাজ নেয়। কিন্তু কম মজুরি আর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে নিজের খরচ চালাতেই হিমসিম খেতে হচ্ছিল তাকে। তাই বাধ্য হয়ে অন্য উপায় খুঁজতে থাকে। একদিন পরিচিত এক ভাইয়ের মাধ্যমে সাইপ্রাসে পাড়ি জমায় মাকসুদা। গত দশ বছরে সাইপ্রাস থেকে পাঠানো টাকায় গাইবান্ধায় নিজেদের পাকা বাড়ি করেছে। আরো সাতজন আত্মীয় স্বজনকে নিয়েছে সাইপ্রাসে। সব মিলিয়ে তার পরিবারই শুধু নয়, তার আত্মীয়-স্বাজনও একটি শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে শুধু মাকসুদার জন্য।

বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে নারীকে বাদ দিয়ে কোনো ধরনের অগ্রগতি আশা করা সম্ভব নয়। কারণ দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী। আর নারীকে উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কর্মকা-সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চাহিদা মোতাবেক নারী কর্মী প্রেরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ১৬০টি দেশে প্রায় ৯৬ লক্ষ বাংলাদেশী বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছেন। দিন দিন নতুন নতুন শ্রমবাজার খুলছে আর নারীর বিদেশে কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে।

দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী সমাজকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক হিসেবে পাঠানোই বর্তমান সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়া, মরিশাস, সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নারীরা এখন কাজ করতে যাচ্ছে। অভিবাসী নারীদের কাজের মধ্যে গৃহকর্মী গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে যাওয়ার সংখ্যাই বেশি। এছাড়া, ক্লিনার, দোকানের সেলস্্কর্মী, ডে-কেয়ার সেন্টার কর্মী, নার্সসহ অন্যান্য পেশায়ও নারীরা যাচ্ছে। তারা শুধু নিজেরা যাচ্ছে তাই নয়, পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের নেওয়ারও চেষ্টা করছে। মূলত নব্বই দশক থেকেই বাংলাদেশের নারীরা বিদেশে কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়া শুরু করে। ২০১৭ সালে লাখ ২০ হাজারের বেশি নারীকর্মী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে যায় যা আমাদের শ্রম অভিবাসনের জন্য একটি রেকর্ড। যদিও সরকারিভাবে ১৯৯১ সালে নারীদের বিদেশে কাজের সুযোগ হয়েছিল কিন্ত গত বছর ধরে বিদেশে নারী কর্মীর যাওয়ার আগ্রহ বেশি পরিমাণে তৈরি হচ্ছে তুলনামূলকভাবে যাওয়ার সংখ্যাও বেড়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চাকুরি নিয়ে বিদেশে গিয়েছে ৪,৪৪,১২৭ জন নারী (সূত্র : বিএসইটি)সবচেয়ে বেশি নারী কর্মী কাজ করছে লেবাননে ৯৯,৭২২ জন। সরকারি তথ্য মতে, শুরু থেকে পর্যন্ত প্রায় পৌনে লাখ নারী কর্মী বিদেশে যায়। শুধু বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৮০ হাজার নারীকর্মী বিদেশে চাকরি পেয়েছেন, যাদের বেশিরভাগ যান সৌদি আরবের গৃহকর্মের পেশায়, যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুরুষ কর্মীরা যাওয়ায় সুযোগ পাচ্ছেন। সে তুলনায় নারী কর্মীদের বেশিরভাগের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের সীমিত কয়েকটি দেশে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নারী অভিবাসন হার পুরুষদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম হবার মূল কারণ আমাদের সমাজের রক্ষণশীল  মানসিকতা।

বিদেশে নারীকর্মী হিসেবে যাওয়ার সর্বনি¤œ বয়স ১৮ বছর। তবে গৃহকর্মী হিসেবে যেতে হলে বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছর হতে হয়। ২০১৪ সালে বিদেশে নারীকর্মী রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৪.৭৬ শতাংশ যা ২০০০ সালে ছিল ২৪.০৪ শতাংশ। বর্তমানে নতুন নতুন শ্রমবাজার খোঁজার জন্য বাইরের দেশগুলোতে অবস্থিত দূতাবাসগুলোতে শ্রম উইং খোলা হচ্ছে। জি টু জি পদ্ধতিতে নারীকর্মী প্রেরণ করছে সরকার। বিভিন্ন দেশে  প্রেরণের আগে চাহিদা মোতাবেক নারী কর্র্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জনশক্তি, কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এর অধীনে দেশের বিভিন্ন স্থানে টিটিসি (কারিগরি প্রশক্ষণ কেন্দ্র) গড়ে তোলা হচ্ছে। বর্তমানে মোট ৩৮টি টিটিসি রয়েছে যার মধ্যে ৬টি টিটিসি শুধুমাত্র নারীদের জন্য করা হয়েছে। এসব টিটিসিতে নামমাত্র প্রশিক্ষণ ফি এর বিনিময়ে বিদেশে গমনেচ্ছু কর্মীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। যে দেশে যেতে ইচ্ছুক, সেই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, পেশাগত প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এসব কেন্দ্রে। প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর কর্মীদের বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ড থেকে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। সরকার ইতোমধ্যে ডাটাবেস তৈরি করেছে নারী কর্মীদের। পরিকল্পিত অভিবাসন নারীর বিদেশ যাত্রাকে আরও নিরাপদ করেছে।

গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ৩০ ভাগ বেড়েছে। বেড়েছে নারী অভিবাসীর সংখ্যাও। তবে বিদেশে নারী অভিবাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের সুরক্ষার জন্য প্রতিশ্রুত ব্যবস্থাগুলো এখনো নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি সমুদ্রপথে মানব পাচারসহ অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনের অর্জন চ্যালেঞ্জ মোকাকিলায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) নারী অভিবাসীদের উন্নয়ন নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ লখের বেশি বাংলাদেশি কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন। যা ২০১৪ সালের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। আর নারী অভিবাসীর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেড়েছে। বছর নারী অভিবাসনকারীর সংখ্যা প্রায় এক  লাখের মতো। তবে অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, মুঠোফোনের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ নিশ্চিত করার মতো অঙ্গীকার এখনো পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি বিদেশে নারী অভিবাসীদের ওপর নির্যাতন রোধ করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

  বাংলাদেশে শ্রমমানের অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত রোডম্যাপের বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিকল্পনা মতো এগিয়ে চলছে। সরকার শুরু থেকেই সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে রোডম্যাপ বাস্তবায়নে কাজ করছে। শ্রমখাতে বিরাজমান ছোটখাট বাধাসমূহ দূর করার জন্য সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের শ্রমমানের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গভর্নিং বডির ৩৪৩তম সভায় বাংলাদেশে শ্রমমানের অধিকতর উন্নয়নে ২০২১-২৬ সময়কালে বাস্তবায়নের জন্য প্রণীত রোডম্যাপের বাস্তবায়ন অগ্রগতি তুলে ধরেন তিনি। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ইতিমধ্যেই জবরদস্তি-শ্রম সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন ২৯ এর প্রটোকল অনুসমর্থনের বিষয়টি অনুমোদন করেছে। এছাড়া, শ্রমসাধ্য কাজে নিয়োগের ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুমোদনের বিষয়ে ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে সহযোগিতা করার জন্য শ্রম অধিদপ্তরের প্রতিটি অফিসে প্রি-অ্যাপ্লিকেশন সার্ভিস ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পখাতেও ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ২০১৩ সালের ১৩২টি থেকে বেড়ে ২০২১ সালে ১০৪৫টিতে উন্নীত হয়েছে। বছর ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমের সফলতা প্রায় ৯০ শতাংশ। শ্রম পরিদর্শকের ৮৯টি পদে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। অতিরিক্ত জনবল অর্থ বরাদ্দসহ কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরকে দ্বিতীয় ধাপে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের ২৩টি কার্যালয়কে লেবার ইন্সপেকশন ম্যানেজমেন্ট এপ্লিকেশন (লিমা) এর আওতায় আনা হয়েছে। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে পরিদর্শন পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করেছে, যা স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পেশাগত সেইফটি কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। বর্তমানে কারখানা পর্যায়ে হাজারের বেশি সেফটি কমিটি কাজ করছে। অধিকন্তু শ্রমিকদের অভিযোগ গ্রহণ নিষ্পত্তির জন্য কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে হেল্পলাইন চালু করেছে। জুন ২০২০ হতে জুলাই ২০২১ সময়কালে অনেক শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ মহিলা শ্রমিক।

বিদেশের শ্রমবাজারে নারী কর্মীদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারী অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নারী শ্রমিক প্রেরনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সাথে আমাদের সমঝোতা স্বারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। অন্যান্য দেশে আমাদের দেশ থেকে নারী গৃহকর্মীর চাহিদার বাজার নিরূপণ করা প্রয়োজন। এতে নারী গৃহকর্মীদের বিদেশে যাওয়ার পথ আরো উন্মুক্ত হবে। আমরা যদি নারী কর্মীদের স্ব-স্ব পেশায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে তারা উচ্চ বেতনে বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োজিত হতে পারবে। এতে করে সে নিজে লাভবান হবে এবং দেশেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ২৬.বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারের এই শাক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণে প্রবাসী নারীরাও অবদান রাখছে প্রতিনিয়ত। নারীর এই ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে আরও শানিত করবে। প্রয়োজন শুধু আমাদের সদিচ্ছা আন্তরিক প্রচেষ্টা আর সমন্বিত উদ্যোগের।

০০-

পিআইডি- শিশু নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) প্রকল্প কার্যক্রম।