বিদ্যালয় বন্ধের সুযোগে ৯২ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে, হতাশ শিক্ষকরা

1

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ।।

করোনাকালে বন্ধ থাকার সুযোগে সাতক্ষীরার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৯২ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। নিয়ে হতাশ শিক্ষকরা। ইউনিয়ন পরিষদ, শিক্ষক, এমনকি প্রতিবেশীরাও বিয়ের কথা জানেন না। বিয়ের কয়েক দিন পর ঘটনা জানাজানি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৬৭, তালার নগরঘাটা গার্লস স্কুলের ১৫ কবি নজরুল বিদ্যাপীঠের ১০ ছাত্রী বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। এরমধ্যে শুধু আগস্ট মাসে তালায় ১৫, সদরে নয়, কলারোয়ায় দুই এবং দেবহাটায় একটি বাল্যবিয়ে হয়েছে।

জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার সাত উপজেলায় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে নয়, ফেব্রুয়ারিতে ১১, মার্চে আট, এপ্রিলে চার, মে মাসে সাত, জুনে সাত, জুলাইয়ে ১২ আগস্টে ৩০টি বাল্যবিয়ে বন্ধসহ ৮৮ কিশোরীকে বিয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে জেলা প্রশাসন জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি। এসব কিশোরীর বেশিরভাগ সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রী বলে জানিয়েছেন জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, জেলার ৭৮টি ইউনিয়নে ৭৮ জন এবং দুই পৌরসভায় নয় জন করে ১৮ জন বিয়ে তালাক রেজিস্ট্রার আছেন। ছাড়া সনাতন ধর্মের বিয়ে পড়ানোর জন্য রয়েছেন একাধিক পুরোহিত। এসব রেজিস্ট্রার পুরোহিত বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করলে অভিভাবকরা চলে যান নোটারি পাবলিক কার্যালয়ে। তবে কোনও কোনও রেজিস্ট্রার বাল্যবিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেন। এই কাজে জনপ্রতিনিধিরা সহায়তা করেন।

সদরের আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ বলেন, বিদ্যালয় বন্ধ থাকার সুযোগে অনেক অভিভাবক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। খোলার পর শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে না আসায় বাড়ি বাড়ি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি পর্যন্ত ৩৫ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। তবে কোনও কোনও ছাত্রী এখনও বিদ্যালয়ে আসছে। বিদ্যালয় খুলে দেওয়ায় বাল্যবিয়ে রোধ সহজ হবে।

তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা ৪৭০। এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী ৬৮ জন। এদের মধ্যে ৪৭ জন ফরম পূরণ করেছে। বাকি ২১ জন ফরম পূরণ করছে না কেন খোঁজ নিতে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন শিক্ষকরা। অধিকাংশ ছাত্রীর গোপনে বিয়ে হয়েছে। আমরা যেন জানতে না পারি সে জন্য অন্য এলাকায় নিয়ে বিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকরা।

তালা উপজেলার নগরঘাটা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক মশিয়ার রহমান বলেন, করোনার মধ্যে আমার বিদ্যালয়ের ১৫ জনের বেশি শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। করোনার কারণে বিয়ে বাড়িতে এখন আয়োজন হয় না। গেটও করে না। কাউকে দাওয়াত না দিয়ে গোপন মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা।

তালার কবি নজরুল বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক ছাইদুল আলম বাবলু বলেন, করোনার স্কুল ছুটিতে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। পর্যন্ত ১০ ছাত্রীর বিয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। এরমধ্যে দশম শ্রেণির চার জন। এদের তিন জন পরীক্ষা দিচ্ছে। বাকিরা নবম অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। করোনায় এত ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হওয়ায় আমরা হতাশ।

জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির প্রশাসনিক প্রধান মো. সাকিবুর রহমান বলেন, পর্যন্ত ৯২ ছাত্রীর বাল্যবিয়ের তথ্য পেয়েছি। আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাচ্ছি। জাতীয় হটলাইনের ১০৯ নম্বরটি অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকে। দু-একটি অভিযোগ গ্রহণ করলেও পদক্ষেপ নেয় না। এমনকি কেউ হটলাইনে যোগাযোগ করলে তারা অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। অনেক সময় উপজেলা প্রশাসন বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে যেতে না পারলে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দায়িত্ব দেন। তারা কৌশলে সবার সঙ্গে সমন্বয় করে উপজেলা প্রশাসনকে ভুল বুঝিয়ে ছাত্রীর বিয়ে দেন।

জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের প্রোগ্রাম কর্মকর্তা ফাতেমা জোহরা বলেন, তথ্য পেলেই বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দিই। কিন্তু মানুষ তথ্য দিতে চায় না। করোনা পরিস্থিতিতে কর্ম হারিয়ে বিপাকে হাজার হাজার পরিবার। মেয়েকে বোঝা মনে করে বাল্যবিয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। করোনাকালে তালায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে।

তালা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, অভিভাবকদের অসচেতনতা বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত তালা উপজেলায় ৬৯টি বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। সংবাদ পেয়েই ঘটনাস্থলে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করি আমরা। কিন্তু পরে অন্য কোথাও নিয়ে লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। এখানে যোগদানের পর বেশি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছি। সে কারণে আমার এখানে সংখ্যা বেশি। অন্যান্য এলাকায় গোপন বাল্যবিয়ে হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, যেসব বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে মামলা করতে হবে। কিন্তু প্রতিদিন নতুন নতুন বিয়ে বন্ধ করতে হিমশিম খাচ্ছি। তাই লুকিয়ে দেওয়া বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যেসব বাল্যবিয়ে হচ্ছে তার কোনও কাগজপত্র দেওয়া হচ্ছে না। মৌখিকভাবে বিয়ে পড়ানো হয়।

জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের উপ-পরিচালক একেএম শফিউল আযম বলেন, করোনাকালে পারিবারিক অসচেতনতায় বাল্যবিয়ে বেড়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধে তৎপর আমরা। কোথাও বাল্যবিয়ে হলে ৯৯৯ কিংবা ১০৯ নম্বরে ফোন দিলে বন্ধের পদক্ষেপ নেয় উপজেলা প্রশাসন। ২০২১ সালে ৮৮টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। তবে থেমে নেই।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বাল্যবিয়ের তথ্য জেনে অবাক হয়েছি। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, অভিভাবকরা গোপনে বিয়ে দিয়েছেন। ইউনিয়ন বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটি সঠিকভাবে কাজ করছে না বলে মনে হয়।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সদরে ৪৯ বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছি। করোনার কারণে কর্ম-তৎপরতা কমেছে। সবাইকে ঘরে থাকার কথা বলেছি। সুযোগে অভিভাবকরা গোপনে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় বাল্যবিয়ে রোধ সহজ হবে।

তালা উপজেলা বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তারিফ-উল-হাসান বলেন, বাল্যবিয়ের ব্যাপারে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর, কিশোর-কিশোরী ক্লাব এনজিও তৎপর। ইতোমধ্যে বাল্যবিয়ে দেওয়ায় অনেক অভিভাবকের কাছ থেকে জরিমানা মুচলেকা নেওয়া হয়েছে। অনেক সময় বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কাগজপত্র পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এরপরও যদি কেউ বাল্যবিয়ে করে, খোঁজ নিয়ে সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।