‘কে আমার পড়ার বই কিনে দেবে? বলো বাবা’

4

বাগেরহাট প্রতিনিধি ।।

ছেলের দুর্ঘটনার খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যেতে চেয়েছিলেন মা। প্রথমে তাঁকে জানানো হয়নি মৃত্যুর কথা। এরপর ছেলের মৃত্যুর কথা শুনেই জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। বাগেরহাটের ফকিরহাটে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত নয়ন দত্তের মা রনজিতা দত্ত কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁর ছোট ছেলে আর নেই। জ্ঞান ফিরলেও কান্না ছাড়া কোনো কথাই বলতে পারছেন না তিনি। একটু পরপরই জ্ঞান হারাচ্ছেন।

শুক্রবার সকালে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বৈলতলী এলাকায় মিনি ট্রাকের ধাক্কায় ইজিবাইকের ছয় আরোহীর মৃত্যু হয়। নিহত ব্যক্তিদের একজন নয়ন দত্ত (২৫)। তাঁর বাড়ি ফকিরহাট উপজেলার নলধা গ্রামে। আজ দুপুরে তাঁদের বাড়িতে দেখা গেছে, শত শত মানুষের ভিড়।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, পাঁচ বছর আগে নয়নের বাবা জগদীশ দত্ত মারা যান। এরপর ছোট ছেলে হলেও সংসারের হাল ধরেছিলেন নয়ন। বাবার পানের বরজ দেখাশোনা থেকে শুরু করে বিক্রি সবই করতেন তিনি। ভাইয়ের লাশ দেখে বাকরুদ্ধ বড় ভাই ভাই বাসুদেবও। বাসুদেব বলেন, ‘আমি বরজে কাজ করছিলাম। এক প্রতিবেশী ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলেন। প্রথমে ভাবছি, মা মনে হয় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কিন্তু গিয়ে দেখি ভাইয়ের লাশ। এই লাশ আমি বইব কী করে?’ বাসুদেব আরও বলেন, ‘আমার ভাইয়ের ওপরেই নির্ভর করে আমাদের সংসার চলত। পাঁচ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পরে সবকিছু নয়নই সামলাত। এ ঘটনায় আমরা তো পথে বসে গেলাম। মায়ের হুঁশ এখনো ফেরেনি। এমনিই মা অসুস্থ। কী হয় ভগবান জানেন।’

দুপুরে ওই বাড়িতে যান ফকিরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সানজিদা বেগম। ইউএনওকে পেয়ে কিছু একটা বলতে একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন নয়নের মা। কিন্তু কিছু বলার আগেই জ্ঞান হারান।

নিহত ব্যক্তিদের আরেকজন রামপালের চাকশ্রী গ্রামের আবদুল হাই (৫৫)। দুপুরে বাড়িতে পৌঁছায় তাঁর লাশ। বাবার লাশ দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে মেয়ে খাদিজা খাতুন। বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, ‘আমাদের এখন কী হবে বাবা, আমরা কোথায় যাব? আর তো কিছুই রইল না। তুমি কেন এভাবে আমাদের রেখে চলে গেলে বাবা, এখন কে আমার জন্য সন্ধ্যায় খাবার আনবে, কে আমার পড়ার বই কিনে দেবে? বলো বাবা।’

অসুস্থ মা, কলেজপড়ুয়া মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছিল আবদুল হাইয়ের সংসার। দিনমজুরি করে পরিবার চালাতেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হওয়ায় বিধিনিষেধের মধ্যেও খুব ভোরে কাজের খোঁজে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। কথা ছিল কোনো কাজ মিললে দিন শেষে বাজার করে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু বাজার হাতে নয়, ফিরেছেন লাশ হয়ে।

নিহত শেখ আবদুল হাইয়ের স্ত্রী নার্গিস বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘স্বামীই ছিল আমার সব। আমাদের তো আর বাঁচার মতো কিছু রইল না। আমি এখন মেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়ে কী করব, তাঁদের কী খাওয়াব?’ স্থানীয় বাসিন্দা আবু তালেব বলেন, পরিবারটি নিতান্তই গরিব। আবদুল হাই দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাত। একটি ছেলে ছিল। সেও দুই বছর আগে মারা গেছে। পরিবারের তিন নারী সদস্য এখন একপ্রকার নিঃস্ব হয়ে গেল বলা যায়।

দুর্ঘটনায় হতাহতদের সবাই ইজিবাইকের যাত্রী। মিনি ট্রাকের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান সবাই। নিহত ছয়জনের মধ্যে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাঁচজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার নলধা গ্রামের প্রয়াত জগদীশ দত্তের ছেলে নয়ন দত্ত (২৫), একই গ্রামের প্রয়াত দিলীপ চন্দ্র রাহার ছেলে উৎপল রাহা (৪১), ফকিরহাটের টাউন নওয়াপাড়া গ্রামের প্রয়াত কালিপদ দের ছেলে গৌর চন্দ্র দে (৫০), বাগেরহাট সদর উপজেলার খানপুর গ্রামের প্রয়াত মোনতার শেখের ছেলে নজরুল শেখ (৫০) এবং রামপাল উপজেলার চাকশ্রী গ্রামের ওহিদ শেখের ছেলে আবদুল হাই (৫০)। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত নূর মোহাম্মদের (৬০) বাড়ি রামপালের বৃচাকশ্রী গ্রামে। তাঁর অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

স্থানীয় শেখ এস্কেন্দার বলেন, ‘পান বিক্রির ওপরেই আমাদের এলাকার অনেক মানুষ নির্ভরশীল। নিহত নয়ন ও উৎপল পানের ব্যবসা করতেন।’

ফকিরহাটের ইউএনও সানজিদা বেগম বলেন, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগামী সোমবার ২০ হাজার করে টাকা দেবেন। ভবিষ্যতেও যেকোনো প্রয়োজনে পরিবারগুলোকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।