করোনা ভাইরাস: অগাস্ট নিয়ে ভয়ে হাসপাতালগুলো

1
Spread the love

বিশেষ প্রতিনিধি ।।

দেশে করোনাভাইরাসের রোগী সংক্রমণ ও শনাক্তে নতুন রেকর্ড হতে যাচ্ছে চলতি জুলাই মাসেই। এরপর অগাস্টের পরিস্থিতি আগের সব হিসাব পাল্টে দিতে পারে, এমন শঙ্কায় রয়েছে এখন রাজধানীর হাসপাতালগুলো।

সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে গত কয়েক সপ্তাহে স্বাস্থ্যসেবায় যে চাপ পড়েছে, তা সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। ঝুঁকিপূর্ণ রোগী বাড়ায় সাধারণ ও আইসিইউ শয্যা কোনোটাই ফাঁকা থাকছে না।

এই অবস্থায় ঈদের আগে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ায় আরও বিপর্যস্ত পরিস্থিতির ভয় চোখ রাঙাচ্ছে এসব হাসপাতালের দায়িত্বশীলদের।

তাদের আশঙ্কা, ঈদযাত্রা-গরুর হাট আর কেনাকাটায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত থাকায় মধ্য অগাস্টে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি সামলাতে আরেকদফা লড়তে হবে।

সে অনুযায়ী প্রস্তুতি রাথার কথা বললেও বাড়তি সেই চাপ সামলাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ী তারা।

মহামারীর গড় দেড় বছরে এখনই সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থা চলছে বাংলাদেশে। করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে গত এপ্রিল থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল। মে মাসে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জুলাই মাসে এসে আগের সব রেকর্ড ভাঙছে।

জুন মাসে যেখানে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। জুলাইয়ের ২০ দিনেই তা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জনের মৃত্যুর বিপরীতে জুলাইয়ের ২০ দিনেই সাড়ে ৩ হাজার মৃত্যু দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে।

এই পরিস্থিতিতে লকডাউন শিথিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে আগেই সতর্ক করেছিল কোভিড সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

হাসপাতালে ঠাঁই নাই >>

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বুধবার সকাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর হাসপাতালগুলোতে ২ হাজার ৭৯টি সাধারণ শয্যা খালি ছিল। আর আইসিইউ শয্যা খালি ছিল ১৩২টি।

তবে ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ বলছে, বাস্তব পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে ধারণক্ষমতা না থাকায় অনেক রোগীকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের ৭০৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে খালি ছিল ৫৪টি।

তবে দেশের সর্ববৃহৎ হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলছেন,

বর্তমানে কোন রোগীই ভর্তি করতে পারছেন না তারা।

তিনি গনমাধ্যমকে বলেন, “বেড, আইসিইউ সব ফিলআপ। প্রচুর রোগী এখন, অধিকাংশ রোগীই বাইরের জেলার।

“অনেক ক্রিটিক্যাল রোগী আসছে এখন। বিভিন্ন জেলা থেকে যারা আসছে, তারা আরও আগে আসলে ভালো হত। কিন্তু তারা যখন দেখছে, কিছুই করার নেই- তখনই তারা আসছে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নজরুল ইসলাম খান বলেন, “এখন আমাদের এখানে রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি। আর সিরিয়াস রোগীই বেশি। আইসিইউ একটাও খালি নেই। কিছু বেড খালি আছে।

গত তিন সপ্তাহ ধরে কোভিড-১৯ রোগীদের ‘অনেক বেশি চাপ’ রয়েছে বলে জানিয়েছেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ।

তিনি বলেন, “আমাদের অর্ধেকের বেশি রোগীই ঢাকার বাইরের। ক্রিটিক্যাল রোগীরাই বেশি আসছে। গত তিন দিন আগে সাতজন মারা গিয়েছিল। প্রতিদিনই গড়ে তিনজন মারা যাচ্ছে। আইসিইউ গত তিন সপ্তাহ থেকে খালি নেই।”

সরকারি হাসপাতালের মতো চিত্র ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও।

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান চৌধুরী জানান, এখন রোগীদের ফেরত পাঠাতে হচ্ছে তাদের।

“আমাদের ৪৫টি বেডই পূর্ণ। প্রতিদিনই রোগীরা ফেরত যাচ্ছে। আইসিইউ ১৬টি, সবগুলোতেই রোগী আছে।”

আইসিইউতে যশোর, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীর রোগী বেশি বলে জানান তিনি।

করোনাভাইরাস মহামারী: মাসের পর মাস>>

ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে কোভিড রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি শয্যা রয়েছে ইমপালস হাসপাতালে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুধবারের ‍বুলেটিনে বলা হয়েছে, এই হাসপাতালে ২৫০টি সাধারণ শয্যার ১৪৪টি ও ৫৬টি আইসিইউ শয্যার ৮টি ফাঁকা রয়েছে।

অথচ হাসপাতালটির চিফ অপারেটিং অফিসার খাদিজা আক্তার বলেন, “আমাদের করোনাভাইরাসের রোগীদের প্রচুর চাপ। বেড-আইসিইউ একদম ফাঁকা নাই। ৫৬টি আইসিইউ আছে আমাদের। সবগুলোই ফিলআপ।”

বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করা বিদেশিরাও এই হাসপাতালে রয়েছেন।

তবে অধিকাংশ রোগীই ঢাকার বাইরের জানিয়ে খাদিজা বলেন, “৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীই ঢাকার বাইরের। এখনকার অধিকাংশ রোগীই ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আসছে। তাদের অক্সিজেনের ডিমান্ড প্রচুর। আইসিইউ রোগীরা খুব খারাপ অবস্থাতেই আসছেন।”

পরিস্থিতির কতটা অবনতি হতে পারে? >>

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে বিধি-নিষেধ আরও বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। সেখানে সবকিছু উন্মুক্ত করে দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়বে।

পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে- সে ধারণা দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক নাজমুল হক বলেন, “আমার ভয় লাগে যে, ইন্দোনেশিয়া-ভারতের পর্যায়ে আমরা না পৌঁছাই। অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে গিয়ে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ মৃত্যু হবে না- এটা বলা যাচ্ছে না। আমরা এটা বলতেও ভয় পাচ্ছি। কিন্তু মনে হচ্ছে এটাই হবে।”

কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এখন সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ নাই। অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে পিকে থাকবে। যদি ঈদের পরের লকডাউন লোকজন মেনে চলে বা কার্যকরী হয়, তাহলে তারপর থেকে কমতে পারে বলে আমার ধারণা।”

গত বছরের এপ্রিলের মতো লকডাউন হলে সংক্রমণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন ব্রিগেডিয়ার নাজমুল।

“মানুষ রাস্তায় থাকবে, আর সংক্রমণ ও মৃত্যু কমবে- এটা আশা করা উচিত না; যেহেতু সবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি,” বলেন তিনি।

একই মত জানিয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ বলেন, “আমার ধারণা অগাস্টের ১৫ তারিখ পর্যন্ত সংক্রমণ এমনই থাকবে। তারপর কমতে পারে।”

ঈদযাত্রা, বিধি-নিষেধ শিথিলের কারণে সংক্রমণ অগাস্ট পর্যন্ত বাড়তে থাকবে বলে মনে করেন। এরপর লকডাউন দিলে তার ফলাফল পাওয়া যাবে অগাস্টের মাঝামাঝির পর।

লোকাল ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি ছিল উপেক্ষিত, যা সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে তোলার শঙ্কা জাগায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিলোকাল ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি ছিল উপেক্ষিত, যা সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে তোলার শঙ্কা জাগায়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

স্বাস্থ্যবিধি না মানার পাশাপাশি গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়াকেও অবনতিশীল পরিস্থিতির কারণ হিসেবে সামনে আনছেন বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক নজরুল ইসলাম খান।

তিনি বলেন, “এখন সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, গ্রামে গ্রামে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। একসময় আমরা বলতাম গ্রামে করোনাভাইরাস নেই। কিন্তু এখন গ্রামই শঙ্কার জায়গা। সংক্রমণ কমবে কি না, তা নির্ভর করবে ঈদের পরের অবস্থার ওপর।

“স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চললেই আমরা আশা করতে পারি- সংক্রমণও কমবে, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও কমবে এবং মৃত্যুর হারও কমবে।”

পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে সে ধাক্কা সামলাতে চেষ্টা চলছে জানিয়ে ইমপালস হাসপাতালের কর্মকর্তা খাদিজা আক্তার বলেন, “ঈদের পরে আমরা আশঙ্কা করছি আরও অনেক বেশি সংক্রমণ বেড়ে যাবে। সেভাবে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।”

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ইমরান চৌধুরী বলেন, “জাতীয় পরামর্শক কমিটি ১৪ দিনের লকডাউনের সুপারিশ করল, অথচ বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়া হল!

“যেভাবে মানুষ বাড়িতে গেল এবং বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়া হল, তাতে আমরা ধারণা করছি সংক্রমণ বেড়ে যাবে। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি, কেননা ঈদের পরে সংক্রমণ বাড়বে।”

সুত্র-বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম