খুলনাঞ্চল ডেস্ক
বাংলাদেশকে করোনার দু’টি ঢেউ অনেকটাই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। প্রথম ঢেউটি ছিল গত বছর উহান করোনার। আর দ্বিতীয় ঢেউটি এবছর ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ কি করোনা ঠেকাতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছিল?
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। জুলাই মাসে করোনা সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর কমে এলেও এখন আবার করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ১৭ হাজার ৪৬৫ জন। শনাক্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৮৩ হাজারেরও বেশি। এখন প্রতিদিন মৃত্যু দুই শ’র উপরে। আর এই মাসেই করোনায় সর্বোচ্চ সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে করোনা টেস্টের ওপর নির্ভর করছে শনাক্তের সংখ্যা। এখন প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হয়। তবে এই টেস্ট বাড়ানো হলে সঠিক পরিস্থিতি বোঝা যেত।
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার আগেই করোনা ঠেকাতে বিমান ও স্থল বন্দরে বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর চলতি বছরের মে মাসে সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পরও ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কাজ হয়নি। করোনা ঠেকানো যায়নি। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন ঠিকমত না করায় এই পরিস্থিতি হয়েছে। গত বছর করোনা ছিল ঢাকা ও শহর কেন্দ্রিক। কিন্তু এবার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শহরের চেয়ে গ্রামে সংক্রমণ বেশি। আর গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে পরিস্থিতি অনেক খারাপ।
করোনার টিকা নিয়েও বাংলাদেশকে হোঁচট খেতে হয়েছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশেকে অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ টিকা দেয়ার চুক্তি করলেও শেষ পর্যন্ত তারা ৭০ লাখের বেশি টিকা দেয়নি। ফলে গত ৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়ার গণটিকা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
এই করোনা ঠেকাতে গত বছর টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি দিয়ে সব কিছু বন্ধ রাখা হয়। আর এবারও লকডাউন ও কঠোর লকডাউ দেয়া হচ্ছে। দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন শেষ হয়েছে ১৪ জুলাই। কিন্তু এই লকডাউনও সঠিকভাবে করা হয়নি। আর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ও মাস্ক পরাতে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মানুষের মধ্যেও সচেতনতা কম। ফলে করোনা ছড়াচ্ছে দ্রুত। তাই বিশ্বের অনেক দেশ করোনা পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এলেও বাংলাদেশে দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা: মো: শহীদুল্লাহ বলেন, ১৫ জুলাই থেকে আমরা আরো দুই সপ্তাহের লকডাউনের প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু উল্টো শিথিল করা হয়েছে। এতে করোনা আরো ছড়িয়ে পড়বে। আর লকডাউন এর আগে ঢিলেঢালা হওয়ায় সংক্রমণ কমানো যায়নি।
বিএসএমইউ-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা: কামরুল ইসলাম বলেন, কোনো দেশই করোনা ঠেকাতে পারেনি। বাংলাদেশের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। তবে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে আমরা এখনো করোনা বিদায় করতে পারছি না। তিনি বলেন, লকডাউন, ভ্যাকসিন, চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যবস্থাপনার সঙ্কট। সমন্বয়ের অভাব শুরু থেকেই আছে। আছে করোনার সময় স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি। ফলে বাংলাদেশ করোনা থেকে বের হতে পারছে না।
ডা: মো: শহীদুল্লাহর মতে, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে লকডাউন পুরোপুরি সম্ভব না। গত ঈদে এক কোটি মানুষ মহানগর থেকে গ্রামে গেল। ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই বৈশ্বিক মহামারী পৃথিবীর কোনো দেশই ঠেকাতে পারেনি।
তবে সঠিক ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা যেত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: লেনিন চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে এটা মোকাবিলার চেষ্টা করিনি। আমরা কোনো পরিকল্পনা করিনি। এপিডেমিক প্রজেকশন করতে হয় তা আমরা করিনি। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যেভাবে চলছে, তাতে বাংলাদেশ ঠিক কবে করোনা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে তা বলা কঠিন।
তবে জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রধান ডা: মো: শহীদুল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশ যে খুব খারাপ করেছে তা নয়। ভারত, ব্রাজিলসহ অনেক দেশের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের পারফরমেন্স তত খারাপ না। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা করা গেলে পরিস্থিতি আরো ভালো করা সম্ভব ছিল।
আর বিশিষ্ট চিকিৎসক এ বি এম আব্দুল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে আর ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। এখানকার মানুষ মনে করে তারা করোনায় নয়, না খেয়ে মারা যাবেন। তাই করোনা ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কাছে।
সূত্র : ডয়েচে ভেলে