করোনায় বেকার কণ্ঠশিল্পী এখন সবজি বিক্রেতা

2

হেদায়েৎ হোসেন

গান ছিল তার প্রাণ। সুরেলা কণ্ঠে গান শুনেছে বহু মানুষ। গানের ওপর ভর করেই ২০১৭ সালে ‘চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ’ প্রতিযোগিতায় হয়েছিলেন দ্বিতীয় রানারআপ। সেই কণ্ঠশিল্পী করোনার কারণে জীবিকার তাগিদে এখন রেললাইনে সবজি বিক্রি করেন।

বলছিলাম খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর আঞ্জুমান রোডের আমতলা মোড় এলাকার বাসিন্দা মো. নান্নুর কথা। ৩২ বছর বয়সী এই কণ্ঠশিল্পী সবজি বিক্রি করে এখন সংসার চালান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নান্নুর পরিবারে রয়েছেন বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান দুই ভাই এবং তিন বোন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ায় সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি কল্পতরু মার্কেটের পাশে সাইমুন আইসক্রিম কারখানায় কাজ করেছেন আট বছর।

কণ্ঠ ভালো হওয়ায় কারখানার সহকর্মীরা নান্নুর কাছে গান শুনতে চাইতো। তিনিও শোনাতেন। এভাবে গানই হয়ে ওঠে তার জীবনের প্রেরণা। ২০১৭ সালে ‘চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় রানারআপ হন। তাকে চিনলো দেশের মানুষ; পেলেন খ্যাতি।

এরপর ২০২০ সালে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে হার্টে রিং বসানো হয়। এতে ব্যয় হয় সাত লাখ টাকা। ‘চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ’ প্রতিযোগিতা থেকে প্রাপ্ত পুরস্কার বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে এই অর্থ পেয়েছিলেন। সব খরচ করেছেন চিকিৎসায়। অসুস্থ হওয়ার পরও বিভিন্ন অঞ্চলে সংগীত পরিবেশন করে সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু করোনার কারণে সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েন। পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে ছিলেন। উপায় না পেয়ে দৌলতপুর রেললাইনের পাশে সবজি বিক্রি শুরু করেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, নান্নুর দোকানে রয়েছে পেঁপে, পটল, করলা, বরবটি, বেগুন লাউসহ নানা জাতের সবজি। হাতে গিটারের বদলে দাঁড়িপাল্লা। কণ্ঠে গানের বদলে সবজি বিক্রির হাঁকডাক।

কণ্ঠশিল্পী নান্নু বলেন, ‘জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া দেশের মানুষ আমাকে শিল্পী হিসেবে চেনেন। দেশের নাম করা গুণী কণ্ঠশিল্পীদের মুখোমুখি হয়েছিলাম। খ্যাতিও পেয়েছিলাম। কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না।’

তিনি বলেন, ‘জীবনে কোনও কাজই ছোট নয়। বর্তমানে করোনার কারণে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ। বসে থাকলে পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে থাকবে। তাই সবজির দোকান দিয়েছি। জীবন-জীবিকার জন্য আত্মনির্ভরশীল হয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি। এরই নাম জীবন সংগ্রাম।’

নান্নুর বাবা হালিম মোল্লা বলেন, ‘১১ সদস্যের সংসার আমাদের। আমি একমাত্র উপার্জনক্ষম। বড় ছেলে নান্নু গান করতো। কিন্তু করোনার কারণে সব অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেকার। দুই বছর ধরে অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারে না। এখন সংসারে অভাব। তাই সবজি বিক্রি করে। দুই জনের সামান্য আয় দিয়ে কোনও রকমে সংসার চলে। ছোট ছেলে প্রতিবন্ধী। ছেলেমেয়ে নাতিদের লেখাপড়া করানো কঠিন।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট খুলনার উপদেষ্টা শাহীন জামান পন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক কর্মী শিল্পীদের প্রণোদনা দিচ্ছেন। শিল্পীরা তাদের সমস্যার কথা কাউকে বলতে পারেন না। হাত পাততে পারেন না। তাই ধারাবাহিকভাবে সব শিল্পীকে প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। মাসিক ভিত্তিতে শিল্পীদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে শিল্পীদের তালিকা করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তালিকা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে শিল্পীদের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত খুলনার তিন হাজার শিল্পী অনুদান পেয়েছেন।

খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল কর্মকর্তা সুজিত কুমার সাহা বলেন, ‘সরকারিভাবে শিল্পীদের সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠান ১০৭ জন অসচ্ছল শিল্পী সরকারি সহায়তা পাবেন। এটি প্রক্রিয়াধীন।’

তিনি বলেন, ‘তবে কণ্ঠশিল্পী নান্নু এবার সহায়তার তালিকায় নেই। আগে দুবার সহায়তা পেয়েছেন। নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ এলে আবার সহায়তার আওতায় আসবেন তিনি।’