করোনাভাইরাস মহামারিতে ই-নথি কার্যক্রমের সফলতা

4
Spread the love

-কুমার বিশ্বজিত রায়

করোনাভাইরাস মহামারিতে ই-নথি কার্যক্রম পেয়েছে নতুন মাত্রা। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সবগুলো দপ্তরকে ই-নথিতে সম্পৃক্ত করার লক্ষে কাজ করছে আইসিটি ডিভিশন।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং বাঙালি জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রাম ত্যাগের ফসল আজকের বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করেই বঙ্গবন্ধু কাজ শেষ করে যায়নি। স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করে তিনি তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত নানামুখী দূরদর্শী উদ্যোগ প্রয়াস লক্ষ করলে বিষয়টি খুব সহজে অনুধাবন করা যায়। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রচিত হয় একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেমে যায় সোনার বাংলা নির্মাণের সেই স্বপ্ন। উল্টো পথে হাঁটতে পারে বাংলাদেশ। এরপর নানা চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করেন দেশের জনগণ। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথ্যপ্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেন।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা দেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ জ্ঞান ভিত্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঘোষণা করলেন রুপকল্প ২০২১। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রুপকল্পে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁর তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের মানুষ বাংলাদেশের ডিজিটাল সেবা ভোগ করছেন। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, দক্ষতা, কর্মসংস্থান, উদ্ভাবন ইত্যাদি প্রতিটি সেক্টরেই আজ ব্যবহৃত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমাধান। সেই সাথে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক মোবাইল ফোন গ্রাহক বিপুল হারে বাড়ছে। ফলে ডিজিটাল সেবায় মানুষের আগ্রহও বাড়ছে

আইসিটি ডিভিশনের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সিটিজেন সেবা রয়েছে প্রায় হাজার। এরমধ্যে মানুষ এখন প্রায় হাজার ১১৯টি সেবা অনলাইনের মাধ্যমে তথা ডিজিটালি গ্রহণ করছে। রুপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের আর মাত্র বাকি ছয় মাস। এই সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে হাজারেরও বেশি সেবা ডিজিটাল করতে কাজ করছে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।

অনলাইনে বর্তমানে যেসব সেবাগুলো পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে; বাস-ট্রেনসহ বিভিন্ন টিকিট, বিদ্যুৎবিল, পানির বিল, গ্যাস বিল, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, জমি রেজিস্ট্রেশন, হজ নিবন্ধন, সিটি করপোরেশন বিল, ভ্যাট-ট্যাক্স, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ফি, অনলাইন বিভিন্ন বুকিং, অনলাইনে কেনাকাটার মতো প্রায় হাজার ১১৯টি সেবা পাওয়া গেলেও আরো অনেক সেবা অনলাইনে যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইসিটি ডিভিশন।

আইসিটি বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, জনগণকে সরকারি সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে দিতে সরকার ‘এক সেবা’ প্লাটফর্ম চালু করেছে। আর সরাসরি সরকারি দপ্তরে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২০২০ সালের জানুয়ারি চালু করা হয় ‘মাইগভ অ্যাপ’যা ই-নথির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। তবে একসেবা মাইগভ অ্যাপের মাধ্যমে বর্তমানে মাত্র ১৭২টি সরকারি সেবা অনলাইনে আবেদন করা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ অধিদপ্তরের প্রায় দুই হাজার ৫০০ সেবা অনলাইনে নেওয়ার লক্ষ্যে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন পরিচালিত প্রোগ্রাম একসেস টু ইনোভেশন-এটুআই।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবসমই চেয়েছিলেন একটি জনবান্ধব প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলে সরকারি কাজে আরো স্বচ্ছতা জবাবদিহি এনে সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের  প্রকৃত সেবক হিসেবে গড়ে তুলতে।

বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশে আজ সত্যির পথে। সরকারি কাজে আরো স্বচ্ছতা জবাবদিহি এনে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে সারা দেশের সরকারি অফিস কর্মকর্তাদেরকে যুক্ত করা হচ্ছে ই-নথি নামক সমন্বিত ডিজিটাল নথি ব্যবস্থায়। ই-নথির কার্যক্রম মূলত শুরু হয় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে। এরই মধ্যে সরকারের সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ অধিদপ্তরগুলোতে ই-নথির মাধ্যমে দাপ্তরিক কাজ শুরু হয়েছে। সবমিলিয়ে ই-নথির অধীনে এসেছে দেশের ৮,২০০টি সরকারি কার্যালয়। দপ্তরগুলিতে পত্র জারি, অফিস আদেশসহ অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ চলছে ই-নথির মাধ্যমে।  ই-নথি ওয়েবসাইট মুঠো ফোনের অ্যাপ ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত নথি নিষ্পত্তি হয়েছে এক কোটি ৫১লাখেরও অধিক নথি

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ই-নথি আসলে কি? এটি হলো প্রচলিত নথি ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ইলেক্টনিক পদ্ধতিতে নথি নিষ্পত্তির একটি প্রক্রিয়া। ই-নথিকে বলা হচ্ছে কাগজহীন সরকারি দপ্তর।

সরকারি কার্যালয়গুলোতে কাজ হয় পুরোনো ফাইলিং পদ্ধতিতে, যা ব্রিটিশ আমল থেকে হয়ে আসছে। এর বিপরীতে ই-নথির মাধ্যমে কাজ অনেক পরিবেশবান্ধব এবং আর্থিকভাবে কম খরচে হয়। আগে সাধারণত সরকারি কার্যালয়, দপ্তর বা বিভাগের কার্যক্রম কম্পিউটারে টাইপ করে বা হাতে লিখে পরিচালনা করা হতো। পরে তা সংরক্ষণ করা হতো। এতে সরকারি দপ্তরে ফাইলের স্তূপ জমত, নাগরিকেরা হয়রানির শিকার হতেন। একটি সাধারণ অফিস আদেশ হতে কখনো কখনো তিন থেকে চারটি টেবিল ঘুরতে হতো। ফলে কমে যেত কাজের গতি। এই ধীরগতির কাজকে দ্রুত করতে লাগত ঘুষ বা স্পিড মানি। এখন ই-নথি কার্যক্রম চালু হওয়ার মধ্যে দিয়ে সরকারি অফিসে কাজের গতি, দক্ষতা, স্বচ্ছতা জবাবদিহি বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণ তার কাঙ্ক্ষিত সেবা পেয়ে যাচ্ছে। সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ই-নথি কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি দ্রুত কার্য সম্পাদনের সুযোগ পাচ্ছেন। সরকারি কাজের সেবাকে ডিজিটাল করতেই ই-নথির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি দিয়ে সরকারি কাজের গতি স্বচ্ছতা বেড়েছে। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে দাপ্তরিক কাজে কমে আসছে দুর্নীতি সময়ক্ষেপণের সুযোগ। নাগরিকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে আবেদন, জমি–জমা, কৃষিতথ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা প্রশাসনিক কাজকর্মসহ সবক্ষেত্রে দ্রুত সেবা দেওয়া হচ্ছে ই-নথি কার্যক্রমে।

ই-নথি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে আইসিটি ডিভিশনের এসপায়ার টু ইনোভেট প্রকল্প।   ই-নথির জাতীয় উপদেষ্টা এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব নিলুফা ইয়াসমিন জানান, ই-নথির মাধ্যমে সরকারি কাজে জবাবদিহি বাড়ছে। ফলে একদিকে যেমন জনদুর্ভোগ কমছে তেমনি জনগণ সরকার আরো কাছাকাছি আসছে।

চলমান করোনাভাইরাস মহামারিতে ই-নথি কার্যক্রম পেয়েছে নতুন মাত্রা। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এই সময়কালে নথি নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৮০টিরও বেশি। আর ই-নথি ওয়েবসাইট মুঠোফোনের অ্যাপ ব্যবহার করে পত্র জারি হয়েছে লাখ ৪১ হাজার ২২৬টিরও অধিক। আর নথি নিষ্পত্তি হয়েছে কোটি ৫১ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৯টি।

কাগজমুক্ত ই-নথি ব্যবস্থাপনা সরকারি কাজে সময় বাঁচাচ্ছে। প্রায় ২০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা ই-নথি অ্যাপ চালাচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ই-নথি অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে। জনগণকে দুর্বার গতিতে সেবা দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুত স্মার্ট হতে হবে। আর দ্রুত কাজ করার ব্যবস্থা ই-নথিতে রাখা হয়েছে।

ই-নথির বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কাজ হচ্ছে বলে এই সেবার স্বচ্ছতা সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করা যায়। সময়ের মধ্যে কাজ নিষ্পন্ন করতে এই সেবা নিজেই সতর্কবার্তা দিচ্ছে। ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে।

এটুআই সূত্রে জানা গেছে, সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় দুটি বিভাগের অধীনস্থ কার্যালয়গুলোতে ই-নথির মাধ্যমে দাপ্তরিক কাজের সূত্রপাত হয়েছে। ইতিমধ্যে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের ৯০ শতাংশের দাপ্তরিক কাজ চলছে ই-নথির মাধ্যমে। সরকারি বেশ কয়েকটি দপ্তরের প্রায় ৭০ থেকে ৯৫ ভাগ কাজ করা হচ্ছে ই-নথির মাধ্যমে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে, কম খরচে হয়রানি ছাড়াই সাধারণ মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে সরকারি সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন কর্মকর্তারা। বিদেশে বা ভ্রমণে থাকা অবস্থাতেও দ্রুততার সঙ্গে কাজ হয়ে যায়। কাজগুলো ঝুলে থাকার সুযোগ নেই। ই-নথি নানাভাবে সরকারের কাজের গতি বাড়াচ্ছে।

সরকারের লক্ষ্য, ই-নথি ব্যবহারে বাধ্যতামূলক পয়েন্ট পাওয়ার জন্য প্রত্যেক সরকারি দপ্তরকে কিছু না কিছু কাজ করতেই হয়। এতে সবার মধ্যে ইতিবাচক সাড়া এসেছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব সরকারি দপ্তরকে ই-নথি ব্যবস্থাপনায় এনে কাগজের ব্যবহার একদম কমিয়ে আনাটাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। (পিআইডি- এটুআই  ফিচার) লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাদেশ টেলিভিশন