0খুলনাঞ্চল রিপোর্ট
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় ৯ জেলার ২৭ উপজেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বুধবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সার্বিক ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আজ সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ভারতের উড়িষ্যা উপকূল অতিক্রম শুরু করে। বিকেল ৪টা নাগাদ এটি উড়িষ্যা অতিক্রম করে। আমাদের এখানে ঘূর্ণিঝড়ের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।
তিনি জানান, অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ২৭টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, শরণখোলা, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, মঠবাড়ীয়া, বরগুনা সদর, পাথরঘাটা, আমতলী, পটুয়াখালী সদর, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, কলাপাড়া, চরফ্যাশন, মনপুরা, তজুমদ্দিন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, ভোলা সদর, হাতিয়া, রামগতি ও কমলনগর। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকদের অনকূলে পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া আছে। এ ছাড়াও আজ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় নয়টি জেলার ২৭টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা দিতে ১৬ হাজার ৫০০ শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ডা. এনামুর রহমান জানান, উপকূলীয় জেলা, উপজেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য আদান-প্রদানে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এনডিআরসিসি (জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র) ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য সংগ্রহ ও আদান-প্রদানে সার্বক্ষণিক কাজ করেছে। উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৭৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, আনসার ভিডিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করছে। ঝড় আঘাত হানলে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত ছিল। মানবিক সহায়তার যথেষ্ট সংস্থান আগে থেকেই করা ছিল। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার জন্য যথেষ্ট মাস্ক এবং স্বাস্থ্য উপকরণ নিশ্চিত করা হয়েছিল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মোহসীন বলেন, প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষয়ক্ষতির হিসাব প্রস্তুত করা হয়েছে। আরেকটা সভা করে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন করা হবে। মাঠের কাজ শেষ হলে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সেটা করব।
সর্বশেষ জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর প্রভাবে উপকূলীয় ১৪টি জেলার অবস্থাও তুলে ধরেন প্রতিমন্ত্রী।
পটুয়াখালী: জোয়ারের পানি বেড়েছে যাওয়ায় গতকাল সন্ধ্যায় ১৭২টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১৪ হাজার লোক আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সকালে তারা ফিরে গেছে। এসব লোকজন জোয়ারের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে আসে এবং ভাটার সময় নিজ নিজ বাড়িতে চলে যায়। এখানে সামান্য ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।
সাতক্ষীরা: জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট বেশি রয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে। জেলায় এক হাজার ২৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। গত রাতে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ২৮০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছিলেন। বর্তমানে তারা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছেন।
বরগুনা: জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়িবাঁধের কয়েক জায়গায় কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ৫২০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরে তারা নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন। সামান্য ঝোড়ো বৃষ্টি হচ্ছে। ইয়াসের প্রভাবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
ঝালকাঠি: জেলায় মোট ৪৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়। ৪৯৭ জন লোক আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। জোয়ারের পানির উচ্চতা বিপৎসীমার উপরে রয়েছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
পিরোজপুর: মঠবাড়ীয়া উপজেলার মাঝের চর বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করায় ১০/১২টি মাছের ঘের এবং কয়েক একর সবজি বাগান পানির নিচে চলে গেছে। মাঝের চর আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা থেকে শুকনা খাবার সরবাহ করা হয়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৩ ফুট উপরে উঠেছে। ২৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।
বরিশাল: এক হাজার ৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়। কোনো লোক আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেননি। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বেশি রয়েছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি।
ভোলা: বর্তমানে আবহাওয়া স্বাভাবিক। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২/৩ ফুট উপরে উঠেছিল। কিন্তু বর্তমানে নেমে গেছে। দুর্গম চরে প্রায় ২৫০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জোয়ারের পানিতে ৯০০ গরু/মহিষ ভেসে গেছে। ৬৯১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছিলেন। এসব লোকজন নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যাচ্ছেন।
বাগেরহাট: জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা ও মোংলা উপজেলার ২০/২১টি গ্রামে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। এতে ২ হাজার ৭০০ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা হিসেবে শুকনা খাবার (চিড়া, গুড় ও খাবার স্যালাইন) সরবাহের প্রস্তুতি নিয়েছে। সকাল থেকে রোদ ছিল। বর্তমানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
চাঁদপুর: আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিছু ছিন্নমূল মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের মধ্যে বিতরণের লক্ষ্যে উপজেলাওয়ারী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পানির উচ্চতা স্বাভাবিক। সামান্য ঝোড়ো হাওয়া বইছে।
লক্ষ্মীপুর: জেলার রামগতি, কমলগঞ্জ উপজেলার নিচু এলাকায় সামান্য জোয়ারের পানি উঠেছে। কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে কোনো লোক আশ্রয় নেননি। সামান্য ঝড়/বৃষ্টি রয়েছে।
খুলনা: জেলায় মোট এক হাজার ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে কোনো লোক আশ্রয় নেননি। ঝোড়ো হাওয়া আছে। জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিক।
ফেনী: জোয়ারের পানি স্বাভাবিক। ঝোড়ো হাওয়া নেই। মঙ্গলবার ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে একজন মারা গেছেন। ৪৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, কিন্তু কোনো লোক আশ্রয় নেননি।
আরও পড়ুন: ‘সব পানিতে তলাইয়া আছে, ক্যামনে কি খামু’
চট্টগ্রাম: জোয়ারের পানি বাড়ছে। বর্তমানে বিপৎসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবহিত হচ্ছে। জেলার মোট ৮৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কোনো লোক আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেননি। ক্ষয়ক্ষতির কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।
নোয়াখালী: জেলায় মোট ৩৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এ সব আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ৩০০ জন লোক আশ্রয় নিয়েছিলেন। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ ফুট উপরে উঠেছিল। নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।