কিছুতেই বিপদ পিছু ছাড়ছে না ম্যনগ্রোভ বন সুন্দরবনের। দুমাস পার হতে না হতেই আবারও বনে আগুনের ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে গত ২০ বছরে বনে ২৩ বার অগ্নিকা- হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। মারা পড়ছে বন্য প্রাণীও।
সোমবার (৩ মে) দুপুরের দিকে সুন্দরবনের দাসের ভারনী এলাকার গহীন বনে আগুনের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে শরণখোলার ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভাতে কাজ শুরু করেছে। বনে অগ্নিকা-ের খবরে ঊর্ধ্বতন বন কর্মকর্তার সেখানে যান। তাদের ভাষ্যমতে, যে স্থানে আগুন লেগেছে তার ব্যাপ্তি যাতে না ছড়াতে পারে সে জন্য বনকর্মীরা (মাটি খুড়ে) ফায়ার লাইন কাটার কাজ শুরু করেছে।
ঘটনাস্থলে থাকা সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের ডিএফও মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন তাৎক্ষণিক আগুনে বনের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা জানাতে পারেননি।
এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারিতে শরণখোলা রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশন এলাকায় বনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। বনবিভাগের হিসেব মতে সে সময়ে প্রায় ৪ শতক বনভূমি পুড়ে যায়। তবে শুষ্ক মৌসুমে বনে বিগত সময়ে অনেকবার আগুন লেগেছে।
বন বিভাগের তথ্য মতে, গেল ২০ বছরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে এ নিয়ে ২৩ বার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবার কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্তের প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি।
শুধু আগুনেই পুড়ছে না সুন্দরবন। বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদই ধংস করে চলছে প্রতিনিয়ত একশ্রেণির চক্র। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ‘স্মার্ট প্রেট্রোলিং’ আর জেলে-বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বাঘ, হরিণ হত্যাসহ বনের সম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে ন। প্রশ্ন উঠেছে বন বিভাগের কর্মকা-ের প্রতি। বিদ্যমান এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে অক্সিজেনের অফুরন্ত ভান্ডার দেশের ফুসফুসখ্যাত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবন অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে দাবি বিশ্লেষকদের।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সালে শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্য এলাকায়, ২০০৪ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্প এলাকায় এবং আড়ুয়াবের খালে, ২০০৫ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের আড়ুয়াবের খালের পশ্চিমে তুলাতলা ও খুটাবাড়ি এলাকায় আগুন লাগে। ২০০৬ সালেই তেরাবেকা খালের পাড়ে, আমুরবুনিয়া, কলমতেজিয়া, পচাকুড়ালিয়া বিল ও ধানসাগর স্টেশন এলাকায় মোট পাঁচটি অগ্নিকা- ঘটে।
২০০৭ সালে বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী নলবন, পচাকুড়ালিয়া বিলে, ২০১০ সালে ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী, ২০১১ সালে ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, ২০১৪ সালে আবারও ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন বনে অগ্নিকা- ঘটে। ২০১৬ সালেও ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, পচাকুড়ালিয়া, তুলাতলী এবং ২০১৭ সালে একই স্টেশনের মাদরাসার ছিলা নামক স্থানে আগুন লাগে।
২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আবারও ধানগারস স্টেশন এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৪ শতক বনভূমি পুড়ে যায় । দুই মাস পেরোতে না পেরোতেই আবারও ৩ মে শরণখোলার দাসের ভারনী এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটল। বন বিভাগের হিসেব মতে, গত ২০ বারের অগ্নিকা-ে সুন্দরবনের ৭১ একর ৭০ শতাংশ বনভূমির গাছ, বিভিন্ন প্রকার ঘাস, লতাপাতা পুড়ে যায়। যার আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা।
অগ্নিকা- এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ তিনটি হচ্ছে, সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী ও খাল খনন, অগ্নিকা- প্রবণ এলাকায় প্রতি ২ কিলোমিটার পরপর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা, চাঁদপাই রেঞ্জের ভোলা নদীর কোল ঘেঁষে বনের পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা রশির নেট দিয়ে বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনটির একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
এদিকে, আবারও বনে আগুনের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য লোকালয় সংলগ্ন নদী-খাল খনন ও কাঁটা তারের বেড়া দেয়া খুবই জরুরি। আমরা বনের সুরক্ষার জন্য প্রায়ই এটা বলে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বনে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীসহ কর্মকর্তারা কতটুকু তৎপর সে প্রশ্ন রয়েছে। বনের সম্পদ রক্ষার স্বার্থে তাদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।’
উল্লেখ্য, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনে আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। কমতে-কমতে বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটারে। যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির সর্বমোট ৫১ ভাগ।
সংরক্ষিত এই বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষণা করে। বর্তমানে যা সমগ্র সুন্দরবনের ৫২ ভাগ এলাকা। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তর জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এই জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।
সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬৮ দশমিক ৮৫ ভাগ অর্থাৎ ৪ হাজার ২৪২ দশমিক ৬ বর্গ কিলোমিটার হচ্ছে স্থল ভাগ। এছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার। এই জল ভাগে ছোট বড় ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার। এরইমধ্যে সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্য মহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গন্ডার, এক প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।
– বাগেরহাট প্রতিনিধি