করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে লকডাউনে কর্মহীন ও অসচ্ছল ২ হাজার ৫৭৭ পরিবারের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে সরকার। যদিও গত ২৫শে এপ্রিল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই হেল্পলাইনে খাদ্য সহায়তা চেয়ে ফোন এসেছে প্রায় ২ লাখ। এর মধ্যে যাচাই বাছাই করে যোগ্য বিবেচিত হওয়ায় প্রায় ১৬ হাজার আবেদনকারীর তথ্য মাঠ প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সরজমিন আবেদন যাচাই করে ২৫৭৭টি পরিবারের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ১৪ই এপ্রিল থেকে জনসাধারণের কার্যাবলী ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। এ পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া এবং দুস্থ নাগরিকদের কাছে মানবিক সহায়তা হিসেবে বিতরণের জন্য নগদ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বরাদ্দকৃত ও পূর্বে মজুতকৃত অর্থ থেকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে চাল, ডাল, তেল, লবণ ও আলু বিতরণের জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়। রোববার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কোনো মধ্যবিত্ত পরিবার যদি খাদ্য সংকটে থাকেন তবে তিনি ৩৩৩ নম্বরে কল দিলে তার বাসায় খাবার পৌঁছে যাবে।
ওইদিন থেকেই ৩৩৩ নম্বরে খাদ্যসেবা আইভিআর কার্যকর করা হয় এবং অসংখ্য কল আসতে শুরু করে। তবে এসব কলের মধ্যে অধিংকাংশই ভুয়া হওয়ায় সেগুলো বাদ দেয়া হয়। প্রকৃত খাদ্য সহায়তা প্রার্থীদের তথ্য মাঠ প্রশাসনে পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরজমিন সেই তথ্য যাচাই বাছাই করে বাড়ি বাড়ি খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন। মাঠ প্রশাসন থেকে খাদ্য সহায়তার তথ্য সংগ্রহ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের জরুরি সাড়াদান কেন্দ্র। আর পুরো বিষয়টি সমন্বয় করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র। জরুরি সাড়াদান কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর স্থানীয় প্রশাসন গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২ হাজার ৫৭৭টি পরিবারের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এ সহায়তা পৌঁছে দেন। ৩৩৩ হেল্পলাইনটি বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের বাস্তবায়নাধীন ও ইউএনডিপি’র সহায়তায় পরিচালিত এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রামের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। এটুআই প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২৫শে এপ্রিল থেকে গতকাল পর্যন্ত ৩৩৩ নম্বরের খাদ্য সহায়তা আইভিআরে ফোনকল এসেছে প্রায় ২ লাখ। এর মধ্যে প্রকৃত সহায়তাপ্রার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ হাজার। যাচাই বাছাইয়ের পর ১৬ হাজার ব্যক্তির তথ্য মাঠ প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে। নাগরিকদের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্যসেবা প্রদানে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩। ২০২০ সালে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে ৩৩৩ নম্বরকে টোল ফ্রি করে সময়োপযোগী অনেকগুলো নাগরিকসেবা যুক্ত করা হয়। ঘরে বসে যেকোনো সময়ে বিনামূল্যে এই হেল্পলাইনে কল করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য পরামর্শ, হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়মকানুন ও করোনাভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য পাচ্ছেন নাগরিকগণ। শুরুতে নাগরিকদের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্যসেবা প্রদান করা হতো এই হেল্পলাইনের মাধ্যমে। সরকার ঘোষিত লকডাউন চলাকালীন সময়ে সাধারণ মানুষদের বিধিনিষেধ মানার লক্ষ্যে ই-কমার্স সেবা, কর্মহীন দরিদ্র নাগরিকদের জন্য ত্রাণ সুবিধা সংক্রান্ত তথ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন তথ্য, নিত্যপণ্য কিংবা ওষুধ ক্রয় ইত্যাদি সেবা এই হেল্পলাইনে যুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকার ঘোষিত লকডাউন চলাকালে কর্মহীন দরিদ্র নাগরিকদের জন্য ত্রাণ সুবিধা সংক্রান্ত তথ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিংবা ওষুধ ক্রয় ইত্যাদি সেবা এই হেল্পলাইনে যুক্ত করা হয়েছে। ৩৩৩ নম্বরের সেবাগুলোকে আইভিআর তথা ইন্টারেক্টিভ ভয়েস রেসপন্সের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। উপযুক্ত নাগরিকগণ যাতে তাদের সেবাটি সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারেন সেজন্য এই আইভিআর সিস্টেমের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে একটি স্ক্রিনিং প্রক্রিয়ায় কলটি এজেন্টের কাছে পাঠানো হয়। এই নম্বরে কল করার পর শূন্য (০) চাপলে সরাসরি সরকারি তথ্য, সেবা ও সামাজিক প্রতিকার বিষয়ক তথ্য পাওয়া যাবে। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য এমনকি করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে জানতে হলে ১ চাপতে হবে। করোনা মোকাবিলায় জরুরি খাদ্য ও অন্যান্য সেবা পেতে ৩ চাপতে হবে এভাবে নিত্যপণ্য দ্রব্য ও ওষুধের জন্য ৫ এবং সাইবার নিরাপত্তাজনিত বিষয়ের জন্য ৮ চাপতে হবে। ৩৩৩ নম্বরে কল করে আইভিআর-এর ৩ অপশনটি শুধুমাত্র বিশেষ মুহূর্তে জরুরি সেবার জন্য তৈরি করা। বর্তমানে কর্মহীন ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল নাগরিকদের জরুরি খাদ্য সহায়তা প্রদানে ব্যবহার করা হচ্ছে। নাগরিকগণের চাহিদা জানানোর পর হেল্পলাইন থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে ত্রাণের চাহিদার তথ্য পৌঁছে দেয়া হয় এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে তাদের নিকট প্রয়োজনীয় ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন। ২০১৮ সালের ১২ই এপ্রিল থেকে চলতি ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছরে ৩৩৩ নম্বরে প্রায় ৩ কোটি ফোনকল গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২১ হাজারের বেশি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, ৬ হাজারের অধিক বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, প্রায় ২০ লাখ সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য প্রদান এবং ৪ লাখ নাগরিক সেবার পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে। মোট ফোনকলের মধ্যে সামপ্রতিক সময়ে ৫০ লাখের বেশি কল এসেছে শুধু করোনা বিষয়ক। স্বেচ্ছাসেবী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দেয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ নাগরিককে। ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে ত্রাণ সাহায্য চেয়ে কল এসেছে ১৮ লাখের বেশি। যথাযথ পদক্ষেপের জন্য এসব তথ্য মাঠ প্রশাসনের কাছে পৌঁছানো হয়েছে। অবশ্য এই সেবাটি গত বছরের ৩১শে অক্টোবর বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এ বছর ২৫শে এপ্রিল পুনরায় চালু করা হয়। এটুআই প্রকল্পের কমিউনিকেশনস অ্যান্ড মিডিয়া আউটরিচ কনসালট্যান্ট আদনান ফয়সল বলেন, মধ্যবিত্ত মানুষ তাদের কষ্টের কথা কারো কাছে বলতে পারে না, তারা ফোনের মাধ্যমে তাদের অসহায়ত্বের কথা আমাদের জানাচ্ছে। আমরা তাদের তথ্য মাঠ প্রশাসনের নিকট পাঠাচ্ছি এবং তারা যাচাই বাছাই করে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতেও প্ল্যাটফরমটিতে নাগরিকদের ফোন কলের সংখ্যা বেড়ে যায়। বর্তমানে হেল্পলাইন এজেন্ট, স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তার এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
– সিরাজুস সালেকিন /মানবজমিন