করোনা, লকডাউন কিংবা রোজা। সামাজিক জীবনে এসবের প্রভাব মারাত্মক কিন্তু, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলজুড়ে তারচেয়েও ভয়াবহ সমস্যা এখন সুপেয় পানির সংকট। বৈশাখের তীব্র দাবদাহে সমুদ্রবর্তী এসব এলাকায় শুকিয়ে গেছে খাবার পানির পুকুর। নলকূপের পানি নোনা। খাবার পানি মিলছে না কোথাও। এক কলস পানি সংগ্রহ করতে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে দিতে হচ্ছে লাইন। দেশের অন্য প্রান্তের মানুষ অবাক হলেও ভীষণ সত্য যে এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর সিরিয়াল এলে তবেই মিলছে এক কলস পানি।
শ্যামনগর কৈখালি এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেন শামিম জানান, শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের জয়াখালী গ্রামে সরকারিভাবে খাবার পানির জন্য একটি পুকুর খনন করা আছে। অমল প্রামান্য এই পুকুরের মালিক। কিন্তু, তিনি জেলা পরিষদের দ্বারা খাবার পানির জন্য পুকুর খনন করিয়ে নিয়ে এখন এলাকার মানুষকে আর পানের পানি নেওয়ার সুযোগ দিতে চাইছেন না। এ পুকুরে এখন তিনি মাছ চাষ করছেন। সেখানে মাছের খাদ্য প্রয়োগ করায় পুকুরের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এরপরেও কেউ পানি নিতে নিতে গেলে তার পরিবার পানি নিতে বাধা দেয়। পুকুর থেকে পানি সংগ্রহের করার জন্য যে ফিল্টারের পাইপ সরকারিভাবে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটি তারা তুলে সরিয়ে দিয়েছে। এদিকে, প্রচ- রোদ, ভয়াবহ গরম। তেষ্টায় গ্রামের মানুষের বুকের ছাতি ফেটে যায় অবস্থা। এই গরমে বার বার পরিবারটির কাছে গ্রামের মানুষ আকুতি জানালেও তারা কোনও পাত্তা দিচ্ছে না।
পুকুর মালিক অমল প্রামান্য বলেছেন, পুকুর থেকে বিভিন্ন জায়গার মানুষ পানি নিয়ে যাচ্ছে। এতে পুকুর শুকিয়ে যেতে পারে, সেজন্য তিনি কাউকে পানি দিতে চাইছেন না।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর সব পুকুরে নোনা পানি ঢুকে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে। এ মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে পানির ব্যবস্থা না করলে মানুষ তীব্র পানি সংকটে পড়বে। এতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
একই এলাকার বাসিন্দা আক্তার হোসেন বলেন, এক কলস পানির জন্য মানুষ তিন-চার ঘণ্টা প্রচ- রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে। তারা ৩/৪ কিলোমিটার দূর থেকে এসে জয়াখালী মোড় সংলগ্ন আকিজ কোম্পানির তৈরি পানির ফিল্টার থেকে পানি নিচ্ছে। কিন্তু ফিল্টারে যে পানি আছে তা দুই একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তারপর যে কী হবে তা কেউ জানে না। তিনি এ বিষয়ে জরুরি সহায়তার জন্য সরকারি, বেসরকারি সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এ অবস্থা শুধু কৈখালি ইউনিয়নে নয়, এর আশেপাশের রমজাননগর, ঈশ্বরীপুর, বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুরসহ গোটা উপকূলে একই অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানান শ্যামনগর সদরের আজিজুর রহমান, বুড়িগোয়ালিনীরর আব্দুল হালিম, মুন্সিগঞ্জের বেলাল হোসেন, পিযুষ বাউয়ালিয়াসহ অনেকেই।
স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা লিডার্সের পক্ষ থেকে সুপেয় পানি সংকট নিরসনে কাজ করা হচ্ছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার বিশ্বাস জানান, খরায় খাল-বিল-পুকুর শুকিয়ে গেছে। নলকূপেও পানি ঠিকমতো উঠছে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পানির জন্য এসব এলাকায় এখন একপ্রকার হাহাকার অবস্থা।
তিনি আরও জানান, সুপার সাইক্লোন আম্পানে উপদ্রুত উপকূল সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নিরাপদ খাবার পানির দাবিতে সম্প্রতি কয়েক দফা মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ করেছে।
কলেজ শিক্ষক দেবদাস সরকার বলেন, সুপার সাইক্লোন আম্পানে উপকূলের বেড়িবাঁধ ভেঙে সর্বত্র নোনা পানি ঢুকে পড়ে। বাড়িঘর, ফসলি জমি, মাছের ঘের ভেসে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই এলাকার একমাত্র পানির উৎস পানির আঁধার (পুকুরগুলো)। কোথাও কোনও সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকায় এনজিও লিডার্স পানির ব্যবস্থা করছিল। কিন্তু, দশমাস পর তারাও দু’দিন পানি দিতে না পারায় সংকট এখন তীব্র। এ মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে পানির ব্যবস্থা না করলে মানুষ তীব্র পানি সংকটে পড়বে। এতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
এদিকে স্থানীয় সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার বলেন, বুড়িগোয়ালিনী এলাকায় খাবার পানির সংকট নিরসনে সেখানে একটি পানির প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। তবে অন্যান্য জায়গায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনে তিনি উপজেলা প্রশাসনকে সাথে নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন।
তিনি আরও জানান, উপকূলবর্তী ইউনিয়নগুলোতে সুপেয় পানির চরম সংকট নিরসনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বরাবর বরাদ্দ পাওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছি। মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অতি দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-ইনস্টিটিউটশনাল রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং (১ লাখ লিটার ক্যাপাসিটি) ১০০টি, ৬০টি পুকুর পুনঃখনন, হাউসহোল্ড বেসিস রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং, গভীর নলকূপ স্থাপন, রিভার্স অসমোসিস প্ল্যান্ট স্থাপন, পিএসএফ সোলার স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রকল্প।
– সাতক্ষীরা প্রতিনিধি