চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমের চৈত্র শেষ হয়ে বৈশাখ উকি দিচ্ছে। এখন সারাদেশের মত ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের সকল মাঠের বোরো ক্ষেতগুলো কৃষকদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কিন্ত চলতি মৌসুমে এখনও বৃষ্টির দেখা মেলেনি। একদিন মাত্র আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখা দিলেও তা ছিল কিছুটা ঝড়ো বাতাস আর ধুলা শান্ত করা ছিটেছাটা বৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ। যে কারনে এলাকার ছোট বড় সব জলাশয়গুলো এখন শুকিয়ে ঠনঠনে। চৈত্রের তাপদাহের সাথে পাল্লা দিয়ে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এতে অকেজো হয়ে পড়েছে বাসাবাড়িসহ মাঠের অসংখ্য গভীর ও অগভীর নলকুপ। ফলে বিঘিœত হচ্ছে বোরোর ভরা মৌসুমের সেচকাজ। অবস্থাটা এমন চারিদিকে খাওয়ার ও গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত পানির সঙ্কটে জনদূর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। দুই একটি নলকূপে কিছুটা পানি মিললেও সেখানে থাকছে সব বয়সী মানুষের পানি সংগ্রহের ভীড়। শুধু শহর নয় গ্রামাঞ্চালের মানুষও পানির জন্য পড়েছেন মহা ভোগান্তিতে।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন মাঠে গেলে দেখা যায়, সকল মাঠেই ভরা বোরো ক্ষেত। চলছে শেষদিকের সেচকাজ। কিন্ত স্যালোমেশিনগুলোতে ঠিকমত পানি উঠছেনা। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেকগুলো বিকল হয়ে পড়েছে। আবার কেউ কেউ ১০ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত খুঁড়ে স্যালোমেশিন বসিয়ে সেচকাজ চালাচ্ছেন। যে গুলো সচল আছে পানি উঠছে খুবই কম। আবার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ নকলূপ বিকল হয়ে পড়েছে। গৃহিণীরা দুর থেকে পানি এনে গৃহস্থালীর পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। তবে যাদের বাসাবাড়িতে বিশেষ পদ্ধতিতে পানি ব্যবস্থা করেছেন তারা প্রতিবেশিদের পানি দিয়ে মহৎ কাজ করছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অফিসসূত্রে জানাগেছে, ২০০৩ সালের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরীক্ষা নিরীক্ষা ও জরিপ মতে,কালীগঞ্জ উপজেলায় মোট ২৯ হাজার ৫’শ ৬৩ টি অগভীর নলকুপ রয়েছে। আর গভীর নলকূপ আছে ৩’শ ৮৪ টি। গ্রীষ্মের শুরুতে প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরেও পানির স্তর বেশ নেমে গেছে। ফলে অনেক নলকূপে পানি উঠছে না। অফিসসূত্রে আরও জানাগেছে, বোরো চাষের কিছু কিছু এলাকাতে ৩৫ থেকে ৩৮ ফুট পর্যন্ত পানির স্তর নেমে গেছে।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, লকডাউনের সময়ে করোনার মহামারী থেকে বাঁচতে সকলেই চাচ্ছেন নিজ ঘরে অবস্থান করতে। কিন্ত নিজ বাসা বাড়ির নলকূপগুলোতে ঠিকমত পানি না থাকায় তারা পড়েছেন বেশ ঝামেলায়। সরকারী ও স্বাস্থ্যবিভাগের নির্দেশনা এখন বেশি করে হাত ধুয়ে পরিচ্ছন্ন পরিপাটি থাকার। পরিষ্কার রাখতে হবে পরিধান ও বিছানাপত্রের কাপড়চোপড় কিন্ত পানির অভাবে চরম বিপাকে তারা। এখনও যে সকল বাসাবাড়ির নলকূপে পানি উঠছে সেখান থেকে নিয়মিত পানির চাহিদা মেটানোও সকলের জন্যই ঝামেলা। মোট কথা একটি পরিবারের জন্য যে পানি প্রয়োজন হয় তার পরিমানটাও একেবারে কম নয়। এছাড়াও বোরো মৌসুমের শেষ পর্যায়ের সেচ কাজ চলছে। ডিজেলচালিত স্যালো মেশিনেও ঠিকমত পানি উঠছে না। অল্প পরিমান পানি উঠায় জ্বালানীবাবদ তেল খরচ লাগছে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। আবার একদিন সেচ দিয়ে প্রচন্ড তাপদাহে পরের দিন ক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অসংখ্য নলকূপ অকেজোও হয়ে পড়েছে। ৮/১০ ফুট মাটি খুঁড়ে স্যালোমেশিন সেট করে কিছুটা পানি উত্তোলন করে সেচকাজ চালাচ্ছেন। ফলে এখন কৃষকদের জন্য বাড়ি ও মাঠে পানির অভাব সমানভাবে দেখা দিয়েছে। তাই মানুষের দৃষ্টি এখন বৃষ্টির দিকে।
কালীগঞ্জ পৌর শহরের ফয়লা গ্রামের (মাষ্টারপাড়ার) বাসিন্দা রাজু আহম্মেদ জানান,তাদের মহল্লার বাসাবাড়ির বেশিরভাগ নলকুপগুলোতে পানি উঠছে না। মটরের মাধ্যমেও ঠিকমত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে তাদের এলাকাতে পৌরসভার সাপ্লাই পানিরও ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে মহল্লার অধিকাংশ পরিবার বাড়ি থেকে বেশ খানিক দুরের প্রতিবেশি শিক্ষক আবু তাহের টিটোর একটি সাব মার্সেপল মটর থেকে পানি খাবার পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। তিনি মহল্লাবাসীর পানির দুরাবস্থা দেখে স্বপ্রণোদিত হয়ে সকাল ও বিকেল পানির ব্যবস্থা করছেন। নির্দিষ্ট সময়নুযায়ী এলাকার যুবকেরা এতে সাহায্য করছেন।
আড়পাড়া গ্রামের গৃহিণী শাহানারা বেগম জানান, মহল্লার দু-একটি পরিবারের নলকূপে পানি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী হলেও তাদের বাসা বাড়িতে যাওয়াটাও উভয়রই কাছে অনিরাপদ মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, পানির অভাবে গোসল ও গৃহস্থালীর কাজের জন্য প্রতিনিয়ত ঝামেলা পোহাচ্ছেন। যতদিন ভারী বর্ষা না হবে ততদিন এমন অবস্থা বিরাজ করবে বলে তারা মনে করছেন।
ফয়লা গোহাটা মসজিদ এলাকার বাসিন্দা সাকাওয়াত আলী জানান,বাসার নলকূপে পানি উঠছে না। বাসা থেকে বেশ দুরের বাড়িতে স্থাপনকৃত একটি সাব মার্সেবল মটর থেকে সকাল বিকেল পানি টেনে বাসায় নিচ্ছেন। ওই গৃহকর্তার উদারতায় তিনিসহ মহল্লাবাসী বেশ উপকৃত হচ্ছেন।
এদিকে উপজেলার খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক আয়ূব হোসেন জানান, মাঠে দোল খাওয়া বোরো ক্ষেতের ধান তাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কিন্ত এ মৌসুমের শেষের দিকে এসে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। অল্প কিছুদিন পরেই ধান পাক ধরবে। তবে কিছু ক্ষেত আছে অনেক পরে লাগানো। সে ক্ষেতগুলোতে এখনও বেশ কয়েকটি পানি সেচ লাগবে। কিন্ত মেশিনে যেভাবে পানি উঠছে তাতে খুব সমস্যা হচ্ছে।
উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের কৃষক জাফর ইকবাল জানান, আগে রোপন করা কিছু ধান ক্ষেতে শিষ বের হচ্ছে। কিন্ত অধিকাংশ নাবী (পরে রোপনকৃত) বোরো ক্ষেতে এখনও চলছে শেষ মূহুর্তের সেচকাজ। কিন্ত পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় ঠিকমত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তিনিসহ গ্রামের বেশিরভাগ কৃষক ১০/১২ ফুট গভীর করে খুঁড়ে স্যালোমেশিন বসিয়ে খুব কষ্ট করে বোরো ক্ষেতের শেষ মূহুর্তের সেচ কাজ চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, শুধু তাদের মাঠেই নয় এলাকার সকল বোরো ক্ষেতের মাঠগুলোতে একই অবস্থা।
কালীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী জেসমিন আরা জানান, গ্রীষ্মের সময় এ অঞ্চলের পানির স্তর প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ ফুট নীচে নেমে যায়। এ অবস্থা হলেও পানি পাওয়া সম্ভব। কিন্ত এ বছর একটু আগে থেকেই পানির স্তর ৩০-৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। যে কারনে অনেক অগভীর নলকুপ অকোজো হয়ে পড়েছে। আবার গভীর নলকূপগুলোতেও এখন অপেক্ষাকৃত কম পানি উঠছে। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি উপজেলার একটি গ্রামে পানির স্তর মেপে দেখা গেছে ৩৬ ফুট নিচেই নেমেছে পানির স্তর। যে কারনে এ এলাকার অনেক নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ফলে সঙ্কট দেখা দিয়েছে খাবার পানির। এমনটি হওয়ার কারন হিসেবে তিনি বলেন, এ বছর এখনও কোন ভারী বৃষ্টি না হওয়াই পুকুর খালবিলের জমে থাকা পানি শুকিয়ে গেছে। অনেক গ্রামের কৃষকেরা স্যালোচালিত গভীর নলকুপগুলো মাটি খুঁড়ে বেশ গভীরে বসিয়েও তেমন একটা পানি পাচ্ছেন না এমন খবর তারাও প্রতিনিয়ত পাচ্ছেন। তবে অল্প দিনের মধ্যে বৃষ্টি হলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
– সাবজাল হোসেন, বিশেষ প্রতিনিধি