বাংলা লোকগানের খুব উল্লেখযোগ্য শিল্পী ও সাধক ইন্দ্রমোহন রাজবংশী আর নেই। স্বাধীনবাংলা বেতারের খ্যাতিমান গায়ক সঙ্গীতগুরু ও সংগঠক হিসেবে নীরবে নিভৃতে বহুকাল কাজ করে অবশেষে বিদায় নিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার বেলা ১১টার দিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। অন্য অসুস্থতার পাশাপাশি তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন বলে জানা যায়। একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পীর আকস্মিক মৃত্যুতে সঙ্গীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজবংশীর শ্যালিকা শিপ্রা ঘোষ জানান, গত বৃহস্পতিবার ইন্দ্রমোহন রাজবংশী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে ঢাকার মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা শেষে জানা যায়, তিনি করোনা পজিটিভ। পাশাপাশি বুকের সিটিস্ক্যান রিপোর্টে তার ফুসফুসে ৮৫ শতাংশ ইনফেকশন ধরা পড়ে। পরে শিল্পীকে ঢাকার অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরিস্থিতির অবনতি হলে দুদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন জানান, করোনাভাইরাসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। সোমবার হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর ছোট ভাই অনঙ্গমোহন রাজবংশী জনকণ্ঠকে জানান, হাসপাতাল থেকে একাত্তরের এ কণ্ঠযোদ্ধাকে বিকেল চারটায় রাজারবাগ কালী মন্দির মহাশ্মশানে আনা হয়। সেখানে বিকেলে তাকে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়া হয়। তারপর সেখানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তার স্ত্রী দীপ্তি রাজবংশীও বর্তমানে অসুস্থ বলে জানান তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেক শিল্পী ফকির আলমগীর জনকণ্ঠকে জানান, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী দুই সন্তান রেখে গেছেন। ছেলে দীপংকর রাজবংশী থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। মেয়ে সঙ্গীতা রাজবংশী থাকেন জাপানে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে সর্বস্তরের শ্রদ্ধার জন্য তাকে শহীদ মিনারে নেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান ফকির আলমগীর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ইন্দ্রমোহন রাজবংশী যুদ্ধে অংশ নেয়ার পণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। সে সময় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছিল। ইন্দ্রমোহন রাজবংশী নিজের নাম পরিচয় গোপন করে কিছুদিন পাকিস্তানীদের সঙ্গে দোভাষী হিসেবে কাজ করেন। পরে সুযোগ বুঝে সেখান থেকে চলে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গাওয়া শুরু করেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকগান সংগ্রহ করতেন তিনি। সহ¯্রাধিক গীতিকবির লেখা এক লাখের মতো গান সংগ্রহ করেছেন তিনি। ইন্দ্রমোহন রাজবংশী ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্শিদীসহ নানা ধরনের গান খুব যতেœর সঙ্গে গাইতেন। তিনি সরকারী সঙ্গীত কলেজে লোকসঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। সংগঠক হিসেবেও অত্যন্ত সফল ছিলেন। বাংলাদেশ লোকসঙ্গীত পরিষদের এই প্রতিষ্ঠাতা অসংখ্য শিল্পী তৈরি করে গেছেন। বেতার ও টেলিভিশনে গান গেয়েছেন সারা জীবনই। ১৯৬৭ সালে ‘চেনা অচেনা’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শুরু করেন। এর পর অনেক ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির শোক ॥ ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি প্রয়াত ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ খ্যাতিমান শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, দেশের লোকগানের বিকাশে একুশে পদকপ্রাপ্ত এ গুণী শিল্পীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
এছাড়াও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ডেপুটি স্পীকার মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী।
– ঢাকা অফিস