খুলনা মহানগরজুড়ে ভুয়া চিকিৎসকদের রমরমা বাণিজ্য চলছে। কম্পাউন্ডার থেকে অনেকে চিকিৎসক হয়েছেন। প্রশাসনের নাকের ডগায় এ ধরনের কার্যক্রম চললেও দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। ফলে তাদের অপচিকিৎসায় প্রতিনিয়ত প্রতারিত ও সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর পূর্ববানিয়া খামার এলাকার গফফারের মোড়ে ছোট্ট ঘরে মিনি ক্লিনিক খুলে বসেছেন মুজিবর রহমান। সাইনবোর্ডে শুধু লেখা ডা. মুজিবর রহমান। প্রসূতি মায়ের ডেলিভারি করানোসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা তিনি দিয়ে থাকেন। একই রুমের একপাশে ডিসপেনসারি এবং অন্যপাশে পর্দাঘেরা অপারেশন কক্ষ। তিনি বলেন, গরিব মানুষ আসে বিভিন্ন রোগ নিয়ে, আমি শুধু ওষুধ দিই।
সেখান থেকে আরও একটু সামনে বাগমারা প্রাইমারি স্কুলের পাশে ছোট্ট ফার্মেসিতে বসেন বাহারুল ইসলাম। এলাকায় তিনি ডাক্তার বাহারুল ইসলাম নামে পরিচিত। ছোট-বড় সবার সব ধরনের রোগের প্রেসক্রিপশন দেন তিনি। ২০০ টাকা ফি নিয়ে রোগী দেখেন প্রতিনিয়ত।
নগরীর শিপইয়ার্ড মেইন রোডে আল আমিন স্কুলের পাশে আরাফাত হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক কামরুজ্জামান ডিএমএফ পাস করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়েছেন। মেডিসিন ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি পরিচিত। চার বছর আগে র্যাব অভিযান চালিয়ে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়। রূপসায় ড্যাপস হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করাকালে ভুল চিকিৎসায় এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বর্তমানে তিনি রূপসা উপজেলার রূপালী সি ফুড কারখানার পাশে একই নামে ক্লিনিক দিয়েছেন।
এমবিবিএস সনদ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে কামরুজ্জামান বলেন, আমি বাংলাদেশ গ্লোবাল ইনস্টিটিউট থেকে এমবিবিএস ডিপ্লোমা কোর্স করে বের হয়েছি। সার্টিফিকেট দিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠান। এর মূল্য না-থাকলে সরকার তাহলে কেন সেসব প্রতিষ্ঠান চালুর অনুমতি দিয়েছে?
নগরীর শান্তিধাম মোড়ের কাকলীবাগ লেনে চেম্বার দিয়েছেন গোলাম মাসুদ মৃধা। তার দাবি, বাংলাদেশ কম্বাইন্ড মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে তিনি এমবিবিএস পাশ করেছেন। ২০১৪ সালে ভুয়া চিকিৎসক হিসাবে র্যাব-৬-এর সদস্যরা তার চেম্বারে অভিযান পরিচালনা চালায়। ওই সময় তিনি পালিয়ে ঢাকায় চলে যান। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে তাকে কোনো সনদ দেওয়া হয়নি। চিকিৎসা দেওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, আমরা যারা বাংলাদেশ কম্বাইন্ড মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে পাশ করে বের হয়েছি তারা আদালতের শরণাপন্ন হই। দীর্ঘদিন বিচারকার্য চলার পর আদালত আমাদের বৈধতা দেওয়ার বিষয়ে রায় দিয়েছেন। সেজন্য আমরা প্র্যাকটিস করছি।
নগরীর খালিশপুরের আলমনগরে ব্যাপক পরিচিত ‘কবির ডাক্তার’। প্রতিদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার কথিত চিকিৎসাপত্র নিতে, বিশেষ করে অসচেতন নারীদের দীর্ঘ লাইন পড়ে। হাইস্কুলের গণ্ডি পার না-হলেও ওষুধ বিক্রির আড়ালে অধিকাংশ প্রেসক্রিপশনে দামি দামি এন্টিবায়োটিক ওষুধ লেখেন। বছর দুয়েক আগে তার এ অপকর্ম একটি গোয়েন্দা বিভাগ হাতেনাতে ধরে ফেললেও পরে তারা ম্যানেজ হয়ে ফিরে যান। স্থানীয় একটি ক্লিনিকে একজন চিকিৎসকের ফুটফরমাশ খাটতে খাটতে তিনি নিজেই এখন ডাক্তার পরিচিতি পেয়েছেন।
গত কয়েকদিন নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে এমন অসংখ্য ভুয়া চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়া গেছে। বছরের পর বছর তারা বড় বড় সাইনবোর্ড টানিয়ে চিকিৎসার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন। মাঝেমধ্যে প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা চালালেও পুনরায় তারা চিকিৎসা বাণিজ্যে ফিরে যাচ্ছেন।
নগরীর কেসিসি মার্কেটের দোতলায় বেলায়েত হোসেন, জোড়াকল বাজারের শিহাব ডেন্টাল কেয়ার, সিমেট্রি রোডের ডালিয়া দন্ত্য সদনের পিকে কর্মকার, একই রোডে বি কে মণ্ডল, রোজ ডেন্টাল কেয়ারের এ কে বিশ্বাস, ফুলবাড়িগেট এলাকার দীপঙ্কর, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে এসআর মল্লিক, বাগমারা এলাকার ডা. আল আমিন, নতুন বাজার রূপসা ডেন্টাল কেয়ারের বিবেকানন্দ ঢালী, কলেজিয়েট স্কুলের সামনে বালা দন্ত্য সদনের ডা. বি কে ঢালী, শিকদার ডেন্টাল হোমের এস কে শিকদার, নগরীর পিকচার প্যালেস মোড়ের গৌরাঙ্গ সমাদ্দার, খালিশপুরের নিউজপ্রিন্ট মিলের সামনে শফি দন্ত্য সদনের শফিকুল ইসলাম, দৌলতপুরে ডা. রবীন্দ্রনাথ দাশ ও মিজানুর রহমান, নগর আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের দোতলায় এ কে পাণ্ডে নিয়মিত রোগী দেখেন। তাদের কারোরই বিএমডিসির সনদ নেই। কেউ কেউ কোনোদিন স্কুলেও যাননি।
এসব চিকিৎসক সম্পর্কে খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, এত ভুয়া ডাক্তারের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে অভিযান পরিচালনা করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ দেখানো হয়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ ধরনের ভুয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা বিএমএর সভাপতি ডা. বাহারুল ইসলাম বলেন, ওই সব নামধারী চিকিৎসক দেশের শত্রু। দীর্ঘদিন ধরেই জগদ্দল পাথরের মতো তারা জনগণের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে আছেন। মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। অপচিকিৎসায় মারাও যাচ্ছে অনেকে। প্রশাসনের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
-আহমদ মুসা রঞ্জু, যুগান্তর