শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৯, নিখোঁজ ৭

3
Spread the love

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনা নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় এখনো সাতজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে প্রশাসন জানিয়েছে।

সোমবার (৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় সদর উপজেলার সৈয়দপুর কয়লাঘাট এলাকায় নিহতের স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। লঞ্চ ডুবিতে উদ্ধার ২৯ নিহতের মধ্যে শিশু ৬ জন, পুরুষ ৯ জন এবং মহিলা ১৪ জন রয়েছে।

রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে সদর উপজেলার কয়লাঘাট এলাকায় সাবিত আল আসাদ নামের লঞ্চটি একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায়। ২৯ মরদেহ উদ্ধার এবং লঞ্চটি টেনে তোলার পর সোমবার বিকালে আনুষ্ঠানিক উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করা হয়েছে। তবে নিখোঁজদের সন্ধানে নদী এখনও তল্লাশি চলছে।

সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক বলেন, রোববার সন্ধ্যায় একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনায় রাত ২টা পর্যন্ত পাঁচ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ২২ জনের মরদেহ এবং সন্ধ্যা সাতটার দিকে নদীতে ভাসতে থাকা নিখোঁজ আরও দু’জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের ঘোষণা অনুযায়ী নিহতের দাফন ও সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা সহযোগিতায় দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা ৩৬ জন নিখোঁজের অভিযোগ পেয়েছি। যার মধ্যে ২৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ফলে এখনো সাত জন নিখোঁজ আছেন। আমাদের উদ্ধার কাজ রাত পর্যন্ত চলবে।

নিহতরা হলেন মুন্সীগঞ্জ সদরের নড়াইতলীর মুকলেছ মিয়ার মেয়ে রুনা আক্তার (২৪), চৌদ্দামোড়ার সমুর আলীর ছেলে সোলেমান বেপারী (৬০) ও তার স্ত্রী বেবী বেগম (৬০), মালপাড়ার হারাধন সাহার ছেলে সুনিতা সাহা (৪০), মসুরার অলি উল্লাহর স্ত্রী পখিনা (৪৫), উত্তর চর মসুরার আরিফ হোসেনের স্ত্রী বীথি (১৮) ও তার মেয়ে আরিফা (১), সদরের প্রীতিময় শর্মার স্ত্রী প্রতিমা শর্মা (৫৩), চর কিশোরগঞ্জ মোল্লাকান্দির ফাজিলার ছেলে শামসুদ্দিন (৯০), তার স্ত্রী রেহেনা বেগম (৬৫), বরিশাল জেলার উজিরপুরের উটরার খায়রুল হাওলাদারের ছেলে হাফিজুর রহমান (২৪), তার স্ত্রী তাহমিনা (২০), ছেলে আব্দুল্লাহ্ (১), মুন্সীগঞ্জ সদরের দক্ষিণ কেওয়ারের দেবিন্দ্র দাসের ছেলের নারায়ণ দাস (৬৫), তার স্ত্রী পার্বতী রাণী দাস (৪৫), নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কল্যান্দীর সোহাগ হোসেনের ছেলে আজমীর(২), মুন্সীগঞ্জ সদরের নুরপুর রিকাবি বাজারের শাহ আলম মৃধা (৫৫), রতনপাতার স্ত্রী মহারাণী (৩৭), ঢাকার যাত্রাবাড়ির রশিদ হাওলাদারের ছেলে আনোয়ার হোসেন (৫৫), তার স্ত্রী মাকসুদা বেগম (৩০), মেয়ে মানসুরা (৭), মুন্সীগঞ্জ সদরের শেয়াগাঁও পূর্বপাড়ার মিঠুন মিয়ার স্ত্রী ছাউদা আক্তার লতা (১৮), শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ার নুর আলীর ছেলে আব্দুল খালেক (৭০), ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়ার তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে জিবু (১৩), পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির সেকান্দার আলীর স্ত্রী খাদিজা বেগম (৫০), নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলার সেলসারদীর নুরু মিয়ার ছেলে মো. নয়ন (২৯), মুন্সীগঞ্জ পূর্ব নয়াগাঁওয়ের দুখু মিয়ার মেয়ে সাদিয়া (১৮), মুন্সীগঞ্জ সদরের দক্ষিণগাঁওয়ের দুলু মিয়ার মেয়ে জোলা বেগম (৩৪) ও মুন্সীগঞ্জ মালপাড়ার বিকাশ সাহা (২২)।

নিখোঁজ রয়েছেন মুন্সীগঞ্জ মালপাড়ার বিকাশ সাহার ছেলে অনিক সাহা (১২), সিরাজদিখান তালতলার মুছা শেখের ছেলে জাকির হোসেন (৪৫), সদরের ইসলামপুরের নুরুল ইসলামের ছেলে তানভীর হোসেন, মালপাড়ার সিরাজুল ইসলামের ছেলে রিজভী (২০), মধ্য কোডপাড়ার মতিউর রহমানের ছেলে ইউনুস কাজী, রাজধানীর মিরপুরের সিরাজুল ইসলামের ছেলে সোহাগ হাওলাদার এবং মুশকে আলম মৃধার ছেলে জাকির হোসেন (৪৫)।

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, খারাপ আবহাওয়ার জন্য রোববার রাতে উদ্ধারকাজ ব্যহত হয়। এজন্য লঞ্চটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সোমবার সকালে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ দুপুর ১টার দিকে লঞ্চটি উদ্ধার করে। লঞ্চের ভেতর থেকে ২২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘এখনো কয়েকজন নিখোঁজ আছেন বলে স্বজনরা দাবি করছেন। তাদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা ট্রলার দিয়ে আশপাশেও খোঁজ করব। এ ছাড়াও, মাইকিং করা হবে যদি কেউ কোন মরদেহেরে সন্ধান পায় তাহলে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য।’

লঞ্চ উদ্ধারে সহযোগিতা করেন- নারায়ণগঞ্জ সদর থানা পুলিশ, বন্দর থানা পুলিশ, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, আনসার সহ রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকেরা।

লঞ্চডুবির ঘটনায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের এমপি মৃণাল কান্তি দাস, বিআইডব্লিউটি-এর চেয়ারম্যান কমোডোর গোলাম সাদেক, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) জসিম উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক বাবু লাল বৈদ্য বলেন, এসকেএল-৩ নামের কোস্টার ট্যাংকারের (কার্গো জাহাজ) ধাক্কায় সাবিত আল হাসান নামের নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জগামী লঞ্চটি অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গেছে বলে আমরা প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেব।

নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, এতগুলো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে সেখানে অবশ্যই মামলা করা হবে। আমরা শিগগির মামলা করবো। নারায়ণগঞ্জ নৌ থানার ওসি শহীদুল ইসলাম বলেন, ট্যাংকার জাহাজটি লঞ্চটিকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। ওই জাহাজটিকে তাৎক্ষণিক ধরা যায়নি। তবে, এ বিষয়ে আইনগত উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরা জাহাজটি আটকে অভিযানে নামবো। শিগগির জাহাজটিকে আটকের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।

রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিআইডব্লিউটিএ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমভি সাবিত আল হাসানকে’ শহরের কয়লা ঘাট এলাকায় একটি কার্গো জাহাজ ‘এসকেএল-৩’ বেপরোয়া গতিতে এসে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে লঞ্চটি ডুবে যায়। লঞ্চের অনেকে সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন।

লঞ্চ ডুবির ঘটনায় জেলা প্রশাসন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরী ববিকে আহবায়ক করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া, বিআইডব্লিউটিএ পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা) রফিকুল ইসলামকে আহবায়ক করে চার সদস্যের আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই তদন্ত কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

– আসাদুজ্জামান ইমন, ঢাকা