নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় ডুবে যাওয়া এমভি সাবিত আল হাসান লঞ্চটি ১৯ ঘণ্টা পর সোমবার (৫ এপ্রিল) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নদীর ৩৫ ফুট গভীর থেকে ক্রেন দিয়ে তুলে আনে বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’। এ সময় লঞ্চের ভেতরে আটকে থাকা ২২টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে রবিবার (৪ এপ্রিল) রাতে ডুবুরিরা লঞ্চ থেকে পাঁচ নারীর মরদেহ উদ্ধার করেন। এ নিয়ে লঞ্চ থেকে পাঁচ শিশু, ১৮ নারী ও ৮ জন পুরুষসহ ২৭ যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সর্বশেষ ২২টি মরদেহ উদ্ধারের পর অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট এলাকায় এসকে-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়। ওই দিন রাতেই উদ্ধার অভিযান শুরুর পর রাত ৩টার দিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সোমবার সকাল ৮টায় পুনরায় উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়। ফায়ার সার্ভিস, বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, নৌ-পুলিশ ও জাহাজ ‘প্রত্যয়’ উদ্ধার কাজ চালায়। সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ডুবে যাওয়া সাবিত আল হাসান লঞ্চটি টেনে তীরে তোলার পর ভিতর থেকে একে একে মৃতদেহ নিয়ে আসেন ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীর ডুবুরিরা। এ সময় মৃতদের স্বজনের আহাজারিতে নদীর দুই তীরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
দুপুর দেড়টার দিকে উদ্ধার করা লাশগুলো ট্রলার ও স্পিডবোটে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীর কয়লাঘাট এলাকায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় লাশগুলো। এ সময় স্বজনেরা লাশ শনাক্তে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। স্বজনদের পাশাপাশি উৎসুক জনতাও ভিড় জমান লাশগুলো একনজর দেখতে।
ফায়ার সার্ভিস, প্রত্যক্ষদর্শী, নৌ-পুলিশ জানায়, রবিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের লঞ্চ টার্মিনাল ঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালের উদ্দেশে ছেড়ে যায় এমভি সাবিত আল হাসান লঞ্চটি। যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার পথে শীতলক্ষ্যার কয়লাঘাট-মদনগঞ্জঘাট সংলগ্ন নির্মিত তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছে এসকে-৩ নামের বড় আকৃতির একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় আকস্মিকভাবে ডুবে যায় লঞ্চটি। ডুবে যাওয়া লঞ্চে ৫০ জনের বেশি যাত্রী ছিল বলে জীবিত উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা জানিয়েছেন। এরমধ্যে ২০ জন যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। খবর পেয়ে বিআইডব্লিউটিএ, নৌ-পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীসহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। ঘণ্টাব্যাপী বৈরী আবহাওয়ার কারণে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে বাধাগ্রস্ত হয়। খবর পেয়ে রাত থেকেই নদীর তীরে স্বজনরা ভিড় জমাতে থাকেন। স্বজনরা কেউ কেউ ট্রলার ও নৌকাযোগে ডুবে যাওয়া লঞ্চের কাছে গিয়ে লাশ খোঁজার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ নদীর উভয় পাড়ে লাশের অপেক্ষায় বসে থাকেন।
নিহতদের হলেন—মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার রুনা আক্তার (২৪), সদর উপজেলার চৌহদ্দামোড় এলাকার সোলায়মান (৬০), বেবী বেগম (৬০), সুনিতা সাহা (৪০), পাখনা (৪৫), বীথি (১৮), আরিফা (১), প্রতিমা শর্মা (৫৩), শামসুদ্দিন (৯০), রেহেনা বেগম (৬৫), হাফিজুর রহমান (২৪), তাহমিনা বেগম (২০), নারায়ণ দাস (৬৫), পারবতী রানী দাস (৪৫), আজমীর (২), শাহ আলম মৃধা (৫৫), মহারানী (৩৭), আনোয়ার হোসেন (৫৫), মাকসুদা বেগম (৩০), ছাউদা আক্তার লতা (১৮), আব্দুল খালেক (৭০), জবু (১৩), খাদিজা বেগম (৫৩), মো. নয়ন (২৮), সখিনা বেগম (৪৫), সাদিয়া (১১) ও মানসুরা (৭)।
আকাশ পথে র্যাবের হেলিকপ্টার টহল
সোমবার দুপুর থেকে র্যাবের একটি চৌকস দল হেলিকপ্টারে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়। র্যাব-১১ অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম জানান, শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনার পর তীব্র স্রোতের কারণে অনেক লাশ ভেসে যেতে পারে। সে জন্য র্যাব আকাশ পথে টহল দিয়ে কোনও মৃতদেহ ভেসে ওঠে কিনা সেটি নজরদারি করছে। একইসঙ্গে যে লাইটার জাহাজটি এমভি সাবিত আল হাসানকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে, সেই জাহাজটি নদীর কোন জায়গায় লুকিয়ে আছে তাও র্যাবের হেলিকপ্টার খুঁজে দেখছে।
উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা
বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমোডর সাদেক জানান, ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করে অভিযান সমাপ্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার পর বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। সবার যৌথ সহযোগিতায় দুপুর সাড়ে ১২টায় লঞ্চটি উদ্ধার করে নদীর পূর্ব তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। লঞ্চটি সার্চ করে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করে নৌ-পুলিশসহ জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে স্বজনদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করে নৌ-চ্যানেলটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
দুই তদন্ত কমিটি
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসক ও বিআইডব্লিউটিএ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। রবিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি এবং বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষে ৪ সদস্যবিশিষ্ট অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) খাদিজা তাহেরা ববিকে প্রধান করে ৭ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমোডর সাদেক জানান, বিআইডব্লিউটিএ পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা) রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে চার সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জনপ্রতিনিধির বক্তব্য
মুন্সীগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস গণমাধ্যমে বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটছেই। আর এতে প্রাণ হারান বেশিরভাগ মুন্সীগঞ্জের মানুষ। কারণ, মুন্সীগঞ্জের বেশিরভাগ মানুষই নৌপথে যাতায়াত করেন। দুর্ঘটনা এড়াতে বারবার অনুরোধ করার পরও রাতের বেলা লাইটার জাহাজ চলাচল বন্ধ করা যায়নি। একের পর এক বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়।’ তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে জাতীয় সংসদেও কথা বলেছি। তবু মৃত্যুর মিছিল থামানো যায়নি।’ তিনি প্রশাসনের কাছে শীতলক্ষ্যার সরু চ্যানেলে লাইটার জাহাজ নোঙর করে রাখা বন্ধ এবং নৌ-দুর্ঘটনা রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
-ঢাকা অফিস