কালীগঞ্জের ৯ বন্ধুর ঐক্যের জারবেরায় স্বপ্ন দেখাচ্ছে

41
Spread the love

সাবজাল হোসেন, বিশেষ প্রতিনিধি : 

শাহাদৎ.মহিদুল,শামিম,হাফিজ,মিটুল,আজিম,মোক্তার,জামাল,শামিমুর এরা ৯ বন্ধু। তাদের মধ্যে অন্যদিকে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও কর্মক্ষেত্রে যেন একই সুতোয় গাঁথা। এভাবে তারা চলছেন বিগত প্রায় ২০ টি বছর। সকলেই তারা কৃষক পরিবারের সন্তান। পরষ্পরের প্রতি আস্থা আর বিশ্বাস এতোটাই মজবুত যে,বিগত দুই যুগের অধিক সময় ধরে এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত ফুল কিনে ঢাকা- চট্রগ্রামসহ দেশের বড় বড় জেলায় নিয়ে ব্যবসা চালিয়েছেন। এখন সকলেই হয়েছেন আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। পরে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেরাই চাষ করেছেন বিদেশী জাতের ব্যয়বহুল জারবেরা ফুলের। ক্ষেতের ফুল ইতোমধ্যে ফুটতে শুরু করেছে। কিন্ত ব্যয় হয়ে গেছে লক্ষ লক্ষ টাকা।  তাদের ভাষ্য দেশে এর আগে অনেকেই জারবেরা ফুলের চাষ করেছেন। কিন্ত তাদের ক্ষেতের জারবেরার রয়েছে ৮ রঙের এবং উন্নত জাতের। চলতি ফেব্রুয়ারীর বাজার ধরে বিক্রি করে বেশ লাভবান হবেন। তাদের বাড়ি দেশের অন্যতম ফুলনগরী খ্যাত ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা এলাকায়।

সরেজমিনে বালিয়াডাঙ্গা বাজার সংলগ্ন গোপিনাথপুর গ্রামের মাঠে গেলে দুর থেকে নজরে আসে ৯ বন্ধুর ঐক্যের জারবেরার সেট। ক্ষেতে পৌছে দেখা যায় বিদেশি জাতের এই ফুল লাল, সাদা, হলুদ ও গোলাপিসহ ৮টি বাহারি রঙের ধরে আছে। তাকালে নজর  ফেরানোর কোন সুযোগ নেই। তবে এই ফুলের কোন গন্ধ নেই। কিন্ত দেখতে অপরুপ। প্রতিটি গাছে রয়েছে একাধিক ফুল। কোনটি ফুটন্ত. কোনটি অর্ধ ফুটন্ত আবার কোনটি সবেমাত্র কড়ি। যা বিশেষ নজদারিতে রেখে পরিচর্যা সানানো হচ্ছে ফেব্রুয়ারী ঘিরে। কেননা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ বিভিন্ন দিবস পালন হবে এ মাসেই। এ সময় ফুলের কাটতি হবে বিরাট। তাই বাজার ধরতে ব্যস্ততার সীমা নেই তাদের। আর বিকাল হলেই অপরুপ সৌন্দর্য্য দেখতে ভীড় করছেন দর্শনার্থীরাও।

৯ বন্ধুর মধ্যে হাফিজুর রহমান জানান,কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ মাঠেই কৃষকেরা প্রায় ২০ বছর আগে থেকেই দেশি বিদেশি জাতের ফুলের চাষ করে আসছেন। সারাদেশের ফুলের চাহিদা মেটাতে যশোরের গদখালীর পরেই ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ত্রিেেলাচনপুরের স্থান। গোলাপ রজনীগন্ধ্যা, গাঁদা,জারবেরা, সন্ধ্যা মালতি, শিউলিসহ বিভিন্ন দেশী বিদেশী জাতের ফুল কি নেই এ মাঠে ? এলাকা থেকে এ সব ফুল কিনে আমরা ৯ বন্ধু একসাথে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা,চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে বিক্রি করতাম। যা লাভ হতো সকলেই সমান ভাগ করে নিতাম। কারও টাকা কম বেশি হলেও হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। আবার কারও সংসারে বিপদ আপদ আসলে রক্তের ভাইয়ের মত অতীতের ন্যায় এখনও পাশে থাকি। এমন ঐক্যের মধ্যদিয়েই নিজ এলাকার বালিয়াডাঙ্গা – গোপিনাথপুর মাঠে দেড় বিঘা জমি দেড় লাখ টাকা দিয়ে ইজারা নিয়ে ব্যয়বহুল জারবেরার চাষ করা হয়েছে। প্রথমে প্রায় ৪ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে তৈরী করা হয়েছে অসংখ্য বাঁশ খুটির উপর বিদেশী ব্যয়বহুল বিশেষ পলিথিনের ছাউনির সেট। এরপর জমি তৈরী করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পুনে থেকে প্রতিটি ৭০ টাকা দরে চারা কিনে এনে লাগিয়ে পরিচর্যা শুরু করা হয়। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। এখনও প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রতিটি গাছ ফুলে ফুলে ভরে গেছে। তার দাবি দেশে অনেক জাতের জারবেরার চাষ থাকলেও তাদের এ জাতের ফুল সম্পূর্ণই ভিন্ন। এ জাতের জারবেরা একবার রোপন করলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হলে ভালোভাবে ৩ বছর ফুল বিক্রি করা যাবে। বাজারে দাম ভালো থাকলে মোটা লাভও আসবে।

বন্ধুদের আরেকজন শাহাদৎ হোসেন জানান, ক্ষেতে এখনও পরিচর্যাবাবদ প্রতিমাসে ব্যয় হচ্ছে। ক্ষেতে একজন এক্সপার্ট কৃষক রেখেছেন মাসিক বেতন চুক্তিতে। মুলত তিনিই ক্ষেত পরিচর্যা করে থাকেন। তিনি আরও বলেন, সারাবছরই ফুলের চাহিদা থাকে। তবে এদেশে ফেব্রুয়ারীর মাসে এ দেশে কয়টি আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস পালন করা হয় জাকজমকের সাথে। এ দিবস গুলোতে ফুলছাড়া একেবারে চলেই না। ফলে বিক্রি বেড়ে যায় অনেক বেশি। তাই তারা ফেব্রুয়ারীর বাজার ধরতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

বন্ধুদের অন্য সদস্য শামিম আহম্মেদ জানান, বিদেশী জাতের ফুলচাষ। পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা। টাকাও ব্যয় হয়েছে অনেক।  তাই প্রথম থেকেই সকলেই অনেক চিন্তায় ছিলাম। কিন্ত এখন একই ক্ষেতে যেভাবে নানা রঙের ফুল ফুটে আছে তাকালেই মনে দিচ্ছে খুশির দোলা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী তিন বছরে ওই ক্ষেত থেকে যাবতীয় খরচ বাদে কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকা লাভ আসবে।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার এসোসিয়েশনের সভাপতি যশোরের আব্দুর রহিম জানান, জারবেরা বিদেশী জাতের ফুল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ভারত থেকে টিস্যু কলামের উন্নত জাতের জারবেরার চারা এনে নিজে চাষ করেন। পাশাপাশি আরও ৪ কৃষককে উৎসাহিত করে চাষ করান। এ ফুলের চাষ ব্যয়বহুল হলেও লাভও পেয়েছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, জারবেরা বিদেশী জাতের ফুল। এ ফুলের চাষ করতে অভিজ্ঞতাও একটি পূঁজি। জারবেরার ফুল একবার ক্ষেতে রোপন করলে কমপক্ষে ৩ বছর ক্ষেত থেকে ফুল পাওয়া যায়। এ ফুলের স্টিক ক্ষেত থেকে তোলার পর কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ দিন সতেজ রাখা সম্ভব। একবার ফুল ধরা শুরু হলে সারা বছর ফুল ধরতে থাকে। গাছের কান্ড থেকে নতুন ডালপালা হয়ে নতুন কড়ি হয়। একটি গাছ জীবনচক্রে বছরে কমপক্ষে ৫৫ থেকে ৬০টি ফুল দেয়। দাম একেবারে কমে গেলেও প্রতিটি ফুল কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হয়। আর দাম বেশি হলে তো কথায় নেই। পরিচর্যা ঠিক থাকলে ৩ বছরের মধ্যে প্রথম বছরেই যাবতীয় খরচ উঠে যায়। আর পরবর্তী ২ বছরে উৎপাদন ব্যয় কমে যায় ফলে লাভও বেশি হয়। তিনি আরও বলেন বর্তমানে আরও উন্নত জাতের জারবেরার চাষ হচ্ছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন অফিসার হুমায়ন আহম্মেদের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি জানান, গত বছর ফুলের দাম কম পেয়ে এ বছর বেশ খানিকটা ফুলচাষ কমে গেছে। তাছাড়াও করোনাকালীন সময়ে ঢাকার অবস্থা খারাপ বিবেচোনায় নিয়ে অনেকে ফুলচাষ করেননি। তারপরও এ বছর ২৫ হেক্টোর জমিতে দেশি বিদেশী জাতের ফুলের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে বালিয়াডাঙ্গা বাজারের নিকটবর্তী একটি মাঠে ৯ বন্ধু মিলে ভারতীয় জাতের জারবেরার চাষ করেছেন। কয়েকদিন তিনি ক্ষেতও পরিদর্শন করেছেন। ক্ষেতে দাঁড়ালে নানান রঙের ফুল দেখলে মন ভরে যাচ্ছে। এখন ৯ বন্ধুই একই গাছে ফুলের কড়ি হয়ে ধরে থেকে যেন ঐক্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে।