“অন্য দিনগুলোর মতো ছিল না ৭ ফেব্রুয়ারি রোববার। সকালের কুয়াশা বুঝিয়ে দেয় মাঘ মাস শেষ হয়নি। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের ঝিলমিল শুরু হয়। সূর্যের আলো কুয়াশা কাটিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল করে তোলে চারদিক। মৃত্যুর ভয়কে জয় করার প্রতিষেধক এখন মানুষের দোরগোড়ায়”
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
অন্য দিনগুলোর মতো ছিল না রোববার। সকালের কুয়াশা বুঝিয়ে দেয় মাঘ মাস শেষ হয়নি। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের ঝিলমিল শুরু হয়। সূর্যের আলো কুয়াশা কাটিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল করে তোলে চারদিক। এই দিনটি ব্যতিক্রম ছিল দেশের মানুষের জন্য। মৃত্যু ভয়কে জয় করার প্রতিষেধক এখন মানুষের দোরগোড়ায়। বহুপ্রতীক্ষার পর দেশব্যাপী বহুকাক্সিক্ষত কোভিড-১৯ টিকাদান শুরু হয়েছে। গণটিকাদান শুরুর দিন টিকা নিয়েছেন সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, জনপ্রতিনিধি এবং সিনিয়র কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সারা দেশে মোট এক হাজার পাঁচটি কেন্দ্রে একযোগে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। গণটিকা কার্যক্রম শুরুর এই দিনটিকে আনন্দের দিন হিসেবে উল্লেখ করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ভার্চুয়ালি টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সারা দেশে টিকাদান উদ্বোধনের সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। এ সময় বিভিন্ন জেলায় টিকাদান কার্যক্রমে জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এর পরপরই বিভিন্ন জেলায় টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। পরে বেলা সোয়া ১১টায় শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়াও এই কেন্দ্রে ভ্যাকসিন নিয়েছেন জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, ডা. সামন্ত লাল সেন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, বিএমএ সাধারণ সম্পাদক ডা. এহতেশামুল হক ও স্বাচিপ সভাপতি ডা. এমএ আজিজ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ শুরু হয়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমরা নানা কার্যক্রম শুরু করি। আমাদের কার্যক্রম নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছে। আমরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করে গেছি। আজ বাংলাদেশ অনেক দেশের চেয়ে ভালো আছে। আমাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। এ পর্যন্ত যত টিকা তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশে এ টিকাই দেওয়া হচ্ছে।
টিকা নেওয়ার পর কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি সারাবিশে^ ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশসহ সারাবিশে^ই পড়েছে। করোনাভাইরাসের টিকা এই মহামারির বিরুদ্ধে মানবজাতির একটা বড় অর্জন। এই অর্জন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহার করে হয়েছে। আমি টিকা নেওয়ার পর ভালোই আছি। টিকা নিয়ে যারা গুজব ছড়াচ্ছে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা করছে। পুরো বিশ^ টিকা নিচ্ছে, কিছু না কিছু উপকারিতা তো আছেই।
টিকা নেওয়া শেষে কবিতা শোনান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। তিনি বলেন, আপনারা জানেন আমাকে মন্ত্রিসভায়ও কবিতা পড়তে হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা জিজ্ঞেস করেন কবিতা আছে কি না। এটা আমার স্বভাবজাত প্রবণতা। টিকা নেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় আপনাদের দুই লাইন কবিতা শোনাই। ‘যদি বেঁচে যাও করোনার কালে, যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়। জেনো বিজ্ঞান লড়ে গেছে সদা, নেই ভয়, হবে মানুষের জয়।’ এই কবিতা আবৃত্তি করে শোনান তিনি। একই হাসপাতালে টিকা নেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন। এ সময় গুজব ও অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখতে জনগণকে টিকা গ্রহণের আহ্বান জানান মন্ত্রী।
ঢাকার তিন হাসপাতালে টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে টিকাদানের উদ্বোধন করেন তিনি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনের পরপরই এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টিকা নিতে শুরু করেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে টিকা নেননি। মন্ত্রী নিয়মিত একটি ওষুধ নেন। এই ওষুধ চলমান থাকা অবস্থায় টিকা না নেওয়ার পরামর্শ রয়েছে ডাক্তারের।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে কোভিড-১৯ টিকা নেন। কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে তিনি টিকা নেন বলে উপাধ্যক্ষ ডা. সাহাদত হোসেন জানান। তিনি বলেন, প্রথম দিনে ডাক্তার, নার্স, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকা দেওয়া হয়।
টিকা নিয়ে প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের বলেন, আমি টিকা দিয়েছি, কোনো অসুবিধা হয়নি। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি ও হাইকোর্ট বিভাগের ৪০ বিচারপতি টিকা নিয়েছেন। সুতরাং দেশবাসীকে বলব, সবাই যেন দ্রুত নিবন্ধন করেন। স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে সবার আগে দেওয়া হয়েছেÑ এটা প্রধানমন্ত্রীর বিশাল কৃতিত্ব। সুপ্রিমকোর্টের মোট ৫৫ জন বিচারপতি রোববার টিকা নিয়েছেন।
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাদান কেন্দ্রে টিকা নেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। টিকা নেওয়ার পর প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকার ব্যবস্থা করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এ সময় গুজব ও অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে জনগণকে টিকা নেওয়ার জন্য আহ্বানও জানান তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাশেদ খান মেনন ছাড়াও কৃষি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম, একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক অধ্যাপক কাজী কামরুজ্জামানও টিকা নিয়ে সবাইকে ভ্যাকসিন গ্রহণ করার আহ্বান জানান।
ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভ্যাকসিন নিচ্ছেন। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত প্রায় দুশজন ভ্যাকসিন নিয়েছেন। করোনা টিকা নিয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, টিকা অতি সাধারণ জিনিস। ছোটবেলায় এমন টিকার নেওয়ার অভ্যাস আমাদের সবার আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা টিকা নিয়ে সমালোচনা করছে তা ভিত্তিহীন। আমি বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে দেখেছি, এটা নিরাপদ ভ্যাকসিন। বিশে^র অন্যসব দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষও এই মহামারির মধ্যে করোনাভাইরাসের টিকার অপেক্ষায় ছিল।
দুপুরে সচিবালয় ক্লিনিকে টিকা নেন রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। টিকা নিয়ে তিনি বলেন, অনুভূতি অন্যান্য টিকার মতোই। সব পর্যায়ে টিকাদান ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক। মন্ত্রী-এমপিরা অনেকেই টিকা নিচ্ছেন, অপপ্রচারকারীরা ব্যর্থ হয়েছে। জনগণকে নির্দ্বিধায় টিকা নেওয়ার আহ্বান জানান মন্ত্রী। সেখানে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী টিকা নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারি দেশে টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করার পর প্রথম দুদিনে ঢাকায় যে ৫৬৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যেও গুরুতর কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা না যাওয়ায় পরিকল্পনামতো গণটিকাদান শুরু হয়। বাংলাদেশে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেককে এই টিকার দুটি ডোজ দেওয়া হবে। এভাবে আগামী জুনের মধ্যে দেশের সাড়ে ৫ কোটি মানুষকে করোনা টিকা দেওয়া হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে টিকা দেওয়ার পর প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। কারও মধ্যে পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবেন চিকিৎসকরা।
ঢাকার ৫০টিসহ সারা দেশে মোট ১ হাজার ৫টি হাসপাতালে একযোগে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ঢাকায় ২০৪টি এবং দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ২ হাজার ৪০০টি দল টিকাদানে কাজ করে। দুজন স্বাস্থ্যকর্মী এবং দুজন স্বেচ্ছাসেবক মিলিয়ে প্রতিটি দলে চারজন সদস্য ছিলেন। টিকা কার্যক্রম বাস্তবায়নে মাঠে ৪২ হাজার কর্মী কাজ করছেন। প্রথম দিন নির্বিঘ্নে গণটিকাদান করা গেছে। সরকারের কেনা ৫০ লাখ ডোজ এবং উপহার হিসেবে ভারতের পাঠানো ২০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা রয়েছে। অর্থাৎ এখন সরকারের হাতে আছে ৭০ লাখ ডোজ টিকা। প্রথম মাসের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এনে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের গণটিকাদান পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম মাসে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সরকারের হাতে থাকা ৭০ লাখ ডোজে জানুয়ারিতে ৩৫ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে।