বিরোধীরা মানতে নারাজ: গণতন্ত্র সূচকে এগোলো বাংলাদেশ

6
Spread the love

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারে সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার- এ পাঁচ মানদন্ডে বাংলাদেশ ৪ ধাপ উন্নতি করেছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মহামারীর মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্রের পরিসর সংকীর্ণ হলেও বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের তুলনায় এগিয়েছে। পাঁচটি মানদ-ে একটি দেশের গণতন্ত্র পরিস্থিতি বিচার করে ইআইইউ বুধবার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের চার ধাপ উন্নতি হয়েছে। ৫ দশমিক ৯৯ স্কোর নিয়ে ইআইইউর গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ এবার রয়েছে ১৬৫টি দেশ ও দুটি অঞ্চলের মধ্যে ৭৬তম অবস্থানে। গতবছর এ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৮৮; আট ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ উঠে এসেছিল ৮০তম অবস্থানে। তার আগের বছর ৫ দশমিক ৫৭ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ তালিকার ৮৮তম অবস্থানে ছিল। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সালে যখন প্রথম এ সূচক প্রকাশ করে, তখন বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬ দশমিক ১১। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে তা এক ধাক্কায় ৫ দশমিক ৫২ পয়েন্টে নেমে যায়। তার পর থেকে এ বছরই গণতন্ত্র সূচকে সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ গনমাধ্যমকে বলেন, এসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কিসের ভিত্তিতে এসব মুল্যায়ন করে সেটা আমার বোধগম্য নয়। খুব দুর্বল বা নতুন প্রতিষ্ঠান হলেও এটা শিকার করবে না। আর যদি তারা সরকার যা বলে সেই গ্রহণ করে তাহলে তো সেটাকে গবেষণা বলা যায় না। এই প্রতিবেদনে বলা উচিত ছিলো সরকারের ভাষ্যমতে। আর এটা বললে রিপোর্টটি গ্রহণযোগ্য হতো। যদি তারা বলে যে এটা গবেষণা করে পাওয়া গেছে তাহলো হয় এটা কোনো তথ্য বা প্রমাণের সঙ্গে কোনো মিল নেই। তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা বলতে তো দেশে কিছু নেই। নির্বাচন বলে তো কোনো কিছুর কার্যক্রম হয় না। কথা বলা অধিকার বা নাগরিক অধিকার বলতে তারা কি বোঝাতে চেয়েছে সেটা আমি জানি না। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে তো নাগরিক অধিকার অন্যান্য সময়ের তুলনায় আরও সংকুচিত হয়েছে। বহুদলিয় বলতে দেশে এখন সরকার অনুমোদিত বহুদলÑ এখন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এর বাহিরে নয়। এখন অবস্থাটা এমন হয়েছে যে যাতে কোনো দল তৈরি হতে না পারে।

তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলতে সরকারের অনুকুলে থাকলে অন্দোলন করা যাবে। আমরা এখন দেখছি বেশির ভাগ প্রতিবাদে প্রধানমন্ত্রী আশির্বাদ চাওয়া হয়। এসব কিছুই প্রমাণ করে যে প্রধানমন্ত্রীর আশির্বাদ না চাইলে কোনো প্রতিবাদ সভা হওয়াও মুশকিল। যেকোনো নাগরিকের কাছে যদি যথাযথভাবে তথ্য চাওয়া হলে দেখা যাবে যে এসব গবেষণার কোনো ভিত্তি নেই। তারা সরকারের ভাষ্যটা প্রকাশ করেছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য (ভিসি) ড. মীজানুর রহমান বলেন, সারাবিশ্ব যখন গণতন্ত্রের সূচক নিম্নমুখী তখন এটা আমাদের জন্য খুব ভালো খবর। আমাদের দেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ভালোভাবে স্বাধীনতা ভোগ করছে। কারণ বলা হয় যে বর্তমানে কথা বলার সুযোগ নেই। কথা বলার অধিকার দেয়া হয় না। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে ২০ থেকে ৩০টির বেশি টিভিতে অবাধে সকল দলের সকল নেতার যার যা ইচ্ছ সব কিছু বলে যাচ্ছেন। কেউ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে না বা কথা বলার কারণে কেউ কোনো ধরনের সরকারি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেনÑ তাও না।

তিনি বলেন, এর বাইরেও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা ইচ্ছামত কথা বলছেন। যদিও সংসদে বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা কম। যে কয়েকজন আছেন তারা যখনি সুযোগ পাচ্ছেনÑ অনেক বিরোধী দলের সদস্য যে কথা বলতেন অল্প সংখ্যক সদস্যরা সেই পরিমাণ কথা বলছেন। সরকারে বিভিন্ন কর্মকা- নিয়ে তাদের দলিয় যে বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন। এসব মিলেই গণতন্ত্রের সূচকে আমরা এগিয়েছি। আমরা আশা করবো যে বিরোধী দল রয়েছে তারা যদি গঠনমূলক রাজনীতি করে তাহলে গণতন্ত্র আরও ভালো হবে। অর্থাৎ তারা জ্বালাও পোড়াও রাস্তা অবরোধ অগ্নি সংযোগ থেকে বেরিয়ে এসে জনমত গঠনে যে পন্থা রয়েছে সেগুলো অনুসরণ করে তাহলে আমরা আরও অগ্রসর হব।

এক প্রশ্নের জবাবে জবির ভিসি বলেন, গণতান্ত্রিক সূচকের সঙ্গে অর্থনীতির সূচকের সরাসরি কোনো মিল নেই। কারণ অনেক সময় সীমাবন্ধ গণতন্ত্রেও অর্থনীতি ভালো হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মালয়শিয়া এবং সিঙ্গাপুর এসব দেশে একটি সরকার ২০ বছর ২৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। জাপানে বলতে গেলে একটি দলই দেশটি পরিচালনা করে আসছে। যার ফলে এই সূচককে ওইভাবে নেয়া যাবে না। তবে গণতন্ত্রের সূচক উন্নতি হলে উন্নয়ন টেকসই হয়। কারণ তখন উন্নয়ন কর্মকা-ে যে ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো রয়েছে সবাইকে নিয়ে সেগুলো দূর করা যায়। সমাজের সবাই তখন সুফল ভোগ করতে পারে।

অন্যদিকে ২০২০ সালে এ সূচকে পুরো বিশ্বের গড় স্কোর আগের বছরের ৫ দশমিক ৪৪ থেকে কমে ৫ দশমিক ৩৭ হয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, ২০০৬ সালে সূচক প্রকাশের পর থেকে এটাই সবচেয়ে বাজে স্কোর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের গণতন্ত্রের দশার এ অবনমনের পেছনে মহামারীর মধ্যে দেশে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০২০ সালের এ সূচক বলছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ) এখন গণতন্ত্র অথবা আংশিক গণতন্ত্র ভোগ করছে। এর মধ্যে পূর্ণ গণতন্ত্র উপভোগ করছে মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ।

সব সূচক মিলিয়ে কোনো দেশের গড় স্কোর ৮ এর বেশি হলে সেই দেশে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। স্কোর ৬ থেকে ৮ এর মধ্যে হলে সেখানে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’, ৪ থেকে ৬ এর মধ্যে হলে ‘মিশ্র শাসন’ এবং ৪ এর নিচে হলে সে দেশে ‘স্বৈরশাসন’ চলছে বলে ধরা হয়। তাদের বিচারে বর্তমান বিশ্বে ৫৭ দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীনে রয়েছে। এ সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে তিনটি বেশি। এবারের সূচক বলছে, গণতন্ত্রের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে ভারত। ৬ দশমিক ৬১ স্কোর নিয়ে ভারত আছে তালিকার ৫৩ নম্বরে।

এরপর ৬ দশমিক ১৪ স্কোর নিয়ে শ্রীলঙ্কা ৬৮ তম; ৫ দশমিক ৯৯ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ৭৬ তম; ৫ দশমিক ৭১ স্কোর নিয়ে ভুটান ৮৪ তম; ৫ দশমিক ২২ স্কোর নিয়ে নেপাল ৯২তম; ৪ দশমিক ৩১ স্কোর নিয়ে পাকিস্তান ১০৫তম; ৩ দশমিক ০৪ স্কোর নিয়ে মিয়ানমার ১৩৫তম এবং ২ দশমিক ৮৫ স্কোর নিয়ে আফগানিস্তান ১৩৯তম অবস্থানে রয়েছে। ৯ দশমিক ৮১ স্কোর নিয়ে এবারের তালিকার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। শীর্ষ দশে আরও আছে আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউ জিল্যান্ড, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডস। ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য ও জার্মানি পূর্ণ গণতন্ত্রের দেশের তালিকায় থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের স্থান হয়েছে গতবারের মতই ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের’ দেশের তালিকায়। এ ভাগের ৫২ দেশের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কা। আর বাংলাদেশকে এই প্রতিবেদনে রাখা হয়েছে মিশ্র শাসনের দেশের তালিকায়, যেখানে ভুটান, নেপাল, পাকিস্তানসহ ৩৫টি দেশ রয়েছে। তালিকার তলানিতে আছে উত্তর কোরিয়া। এছাড়া ডিআর কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সিরিয়া, চাদ, তুর্কমেনিস্তানকেও নিচের দিকে রাখা হয়েছে।