গেমিংয়ে আসক্ত শিশু-কিশোর, প্রতিকার কোন পথে?

5
Spread the love

বিশেষ প্রতিনিধি

করোনার কারণে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময় একবছর হতে চললো। এসময় বাইরে যেতে পারছে না স্কুলগামী শিশু-কিশোররা। দিনের বেশিরভাগ সময়ই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকছে তারা। কেউ কেউ কিছুক্ষণ অনলাইন ক্লাসে থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই খেলছে মোবাইলফোনে গেম। এই গেম খেলতে গিয়ে তারা অনলাইনে অভিভাবকদের প্রচুর অর্থও নষ্ট করছে। এতে অভিভাবক, মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া, কয়েকজন শিক্ষার্থীও এই গেইম আসক্তির কথা জানিয়েছে। প্রযুক্তির প্রতি বেশি আসক্ত হওয়ার কারণে যাদের নিয়ে এত টেনশন তারা কী ভাবছে? এই নিয়ে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর সাফ জবাব, ‘স্কুল বন্ধ। বাইরে খেলতে যেতে পারি না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না। বাসায় বসে কতক্ষণ টিভি দেখবো, বই পড়বো? সারাদিন কী করবো? তাই গেম খেলি, অনলাইনে বন্ধুদের সঙ্গে কথাও বলি।’

নারায়ণগঞ্জের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রের ঝটপট উত্তর, ‘করোনার জন্য স্কুলে যেতে পারছি না। বাইরে খেলতে, ঘুরতে আর কোথাও বেড়াতে যেতে পারছি না।তাই বাধ্য হয়ে মোবাইলফোনে গেম খেলি। আমার ভালোও লাগে।  তবে, টাকা দিয়ে কোনো গেম খেলি না।’ নারী উদ্যোক্তা জিন্নাত আফরোজ সুকন্যা বলেন, ‘মোবাইলফোন গুরুত্বপূর্ণ গ্যাজেট। তবে বেশিরভাগ সময় বাচ্চাই মোবাইলফোন ব্যবহার করছে নেশার মতো। তাদের আচরণগত সমস্যাও দিনদিন প্রকট হচ্ছে। তাই, বাবা-মার উচিত বাচ্চাদের সময় দেওয়া, কাউন্সেলিং করা। তাদের সঙ্গে ভালো-খারাপ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা।’ ঠাকুরগাঁওয়ের শামীমা ইসলাম বলেন, ‘অনেকক্ষণ মোবাইলফোনের স্ক্রিনে থাকিয়ে থাকার কারণে ভার্চুয়াল-সম্পর্ক বা বন্ধু তৈরিতে তাদের যতটা মনোযোগ দিচ্ছে শিশুরা, তার সিকিভাগও নেই বাস্তব বন্ধুত্বে। গেমিংয়ে ভয়ানক আসক্ত হয়ে পড়ায় পড়াশোনার সময় চলে যাচ্ছে স্ক্রিনে। বাচ্চাদের সামাজিকীকরণে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। তারা বেড়ে উঠছে অসহিষ্ণু হয়ে। না আছে বন্ধু, না হচ্ছে পরিবারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। একঘরে হয়ে পড়ছে তারা।’ এ বিষয়ে লেখক, সাংবাদিক গিয়াস আহমেদ বলেন,‘করোনা আমাদের জীবনটাকেই পাল্টে দিয়েছে। একসময় আমরা মোবাইলফোন, ডিভাইস, নেট থেকে শিশুদের দূরে রাখতে পারলেও এখন তাদের শিক্ষার স্বার্থেই ইন্টারনেট সংযোগসহ মোবাইলফোন, ট্যাব তুলে দিয়েছি। এই সুযোগে তারা আসক্ত হয়ে পড়েছে। বাস্তবতার কারণে তাদের হাত থেকে ডিভাইসগুলো কেড়ে নিতে পারবো না। তাই মানসিকভাবে ওদের সঙ্গ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, তারা কোনো রিস্কি গেমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে কি না। পাশাপাশি, বাবা-মায়েদেরও সন্তানের ভালো শেয়ারিং-কেয়ারিং বন্ধু হতে হবে।’ নোয়াখালীর নারী উদ্যোক্তা সোহানী শারমিন বলেন, ‘করোনায় বাচ্চারা স্কুলে বা বাইরে যেতে পারছে না বলে গেমসে বেশি আসক্ত হয়ে গেছে। বেশি গেমসপ্রীতি থেকে তাদের ফেরাতে আনন্দদায়ক পড়াশোনার উপায় বের করতে হবে। তাহলে তারা গেমস, কার্টুনে সময় কমাবে,পড়াশোনায় মন দেবে।’ দ্রুত স্কুল খুললে এই আসক্তি কমবে বলেও মনে করেন তিনি।

কথাসাহিত্যিক, কবি কাজী মোহিনী ইসলাম তার ১৯ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে উৎকণ্ঠার কথা জানালেন। তিনি বলেন, আমার সন্তান ভয়ানকভাবে গেমে আসক্ত। অনেক রাত পর্যন্ত ডিভাইসে গেম খেলে। সম্প্রতি অনেক রাতে সে গেমে থাকায় রেগে ঘুমাতে যেতে বলি। তখন সে বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ার হুমকি দেয়। নিজের ছেলের এমন আচরণে তিনি ভীষণ ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন।’ ছেলে-মেয়েদের ভয়ঙ্কর এই গেম খেলা নিয়ে কাজী মোহিনী বলেন, ‘আমার নিজের ছেলেসহ অনেকে এই রকম গেমের নিমগ্ন থাকে। ওরা যখন এই জগতে থাকে, সেখানে ভার্চুয়ালি একটা অ্যাকাউন্ট করে অনেক অস্ত্র এবং যুদ্ধের পোশাক কেনে। এসব গেমেরে মধ্যেই সেটাপ করা থাকে। ছোট ছেলে-মেয়েরা কেবল নয় বড়রাও এসব গেম খেলে। এটা এমন মারাত্মক নেশা। যে একবার ঢোকে, সে আর বের হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে সরকারিভাবে এসব গেমের অ্যাপ ও গেটওয়ে সব বন্ধ করে দিতে হবে।’

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক সুব্রত শেখর ভক্ত বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের বেশিরভাগ সময় মোবাইলফোনে গেম নিয়ে থাকার জন্য তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে ডাকলেও তারা বিরক্তবোধ করে। করোনার সময় তাদের পড়াশোনা, কোচিং সব অনলাইনেই সারতে হচ্ছে বলে বাবা-মাকেও খেয়াল রাখতে হবে, বাচ্চারা পড়াশোনার বিষয়ে অনলাইন থাকছে, না গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বকাঝকা করে নয়, তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে বোঝাতে হবে। সন্তানদের বিভিন্ন সামাজিক কাজ, খেলাধুলা বা বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’

চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, ‘বাচ্চাদের জন্য মোবাইল বা অন লাইন অনেক চটকদার দুনিয়া। ওটা থেকে বের হয়ে নরমাল লাইফ আর ভালো লাগে না। এছাড়া, গেম অনেক ফাস্ট। নরমাল লাইফ অনেক স্লো। ফলে ওরা অ্যাডজাস্ট করতে পারে না। বেশি ডিভাইস ব্যবহারে অনেকের ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সালাহউদ্দিন সেলিম বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলেন, ‘পাবজির মতো কিছু গেম আছে, যার একটা লেভেল পর্যন্ত ফ্রি খেলা যায়। সে গেম এমন পর্যায়ে এসে শেষ হয়, পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য ক্রেডিট নিয়ে খেলতে হয়।  ছেলে-মেয়েরা অনলাইনে ক্যাশ বা বাবা-মায়ের ক্রেডিট কার্ডের নম্বর দিয়ে প্রয়োজনীয় পয়েন্ট কিনে নেয়। পয়েন্ট কিনে তারা গেমের বড় বড় ধাপ পার হয়। কিছু গেম খেলতে গেলে তাদের চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। গেমের মাধ্যমে সে ধাপগুলো সে পার হয়। এটা ভয়ানক এক ধরনের নেশা। আর এই নেশাকে কেন্দ্র করে বিরাট একটা চক্র কাজ করছে।’

পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের ডিসি, আ ফ ম আল কিবরিয়ার কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই প্রযুক্তটা বিশ্বময় চলছে। তবে, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ছেলে-মেয়েরা বেশি আসক্ত হচ্ছে। এই বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা এই সিন্ডিকেটকে ধরার চেষ্টা করছি। এর আগে বিটিআরসিকে দিয়ে এসব অ্যাপের গেটওয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। ততদিন বাবা-মায়েরা সন্তানদের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। তাদের হাতে নতুন ডিভাইস দেওয়ার আগে কিছু কিছু শর্ত দিয়ে দিতে হবে। সন্তান বেশিক্ষণ যেন ডিভাইসে না থাকে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।’ প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘সারা বিশ্ব এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। ছোট-বড় সবাই ডিভাইসে কাজ করছে। এটাকে অস্বীকার করা যাবে না। তবে যে বা যারা এর বেশি ব্যবহার করছে, তাদের সচেতন করতে এর ভালো-মন্দ দিক নিয়ে বাবা-মা বা পরিবারের বড়দের কাউন্সেলিং করতে হবে।’ ভালো-মন্দ দিক শিশু বুঝিয়ে বলারও পরামর্শ দেন তিনি।-রাইজিং বিডি