মিয়ানমারে ক্যু

12
Spread the love

# প্রেসিডেন্ট মিন্ট ও সুচিসহ শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার # এক বছরের জরুরী অবস্থা জারি # রাজধানী নেপিডোয় টেলিফোন ও ইন্টারনেট লাইন বিচ্ছিন্ন

খুলনাঞ্চল ডেস্ক::

মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী আউং সান সুচিসহ শাসক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে আটক করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সোমবার ভোরে সেনাবাহিনীর অভিযানে তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছেন দলের মুখপাত্র মায়ো নিউন্ট। অন্যদিকে দেশটির অভ্যুত্থানের ঘটনায় বিশ^ব্যাপী নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। খবর বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা রয়টার্স ও স্ট্রেইট টাইমসের।

ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র মায়ো নিউন্ট বলেন, আউং সান সুচি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতাকে সোমবার ভোরে আটক করা হয়েছে। আমি জনগণকে উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া না দেখানোর আহ্বান জানাই। তারা যেন আইন অনুসারে প্রতিক্রিয়া জানায়। রাজধানী নেপিডো ও প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় সৈন্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। নেপিডোয় টেলিফোন ও ইন্টারনেট লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। সেনা সদস্যরা কয়েকটি অঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করেছে বলে জানিয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।

দেশটির সামরিক বাহিনী গত বছরের নবেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। সেনাবাহিনী নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে সোমবার বসতে যাওয়া পার্লামেন্ট অধিবেশন বাতিলের দাবি জানায়। সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পায়। তবে সেই নির্বাচনে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের ভোটারদের ভোট বঞ্চিত করার সমালোচনা করেছিল মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো। সেনাবাহিনী সমর্থিত বিরোধী জোট নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তোলে। তাদের দাবি নির্বাচনে ৮৬ লাখ ভোট কারচুপি হয়েছে। গত সপ্তাহে সামরিক মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন তুন বলেন, সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাইয়াং যৌক্তিকভাবে নির্বাচনের জালিয়াতিকে চিহ্নিত করেছেন।

জনমনে ক্ষোভ-উদ্বেগ:

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করেছে। ইয়াংগুনের সড়কগুলোতে সেনাবাহিনীর সমর্থকদের জাতীয় পতাকা হাতে আনন্দ করতেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পুনরায় গণতন্ত্রকে পদদলিত করে সেনাবাহিনীর এ ক্ষমতা দখলের গ্রহণযোগ্যতা দেশবাসীর কাছে আসলেই আছে কিনা সে নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিং অং হ্লাইংয়ের ক্ষমতা দখলে কিছু মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ করলেও আপামর জনসাধারণের মনে উদ্বেগ, ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে। ইয়াংগুনের বাসিন্দা জিজাওয়াহ (৩২) বলেন, আমার খুব রাগ হচ্ছে। তারা যেটা করছেন সেটা স্বৈরতন্ত্র। আমরা সবাই জানি আমরা কাকে ভোট দিয়েছি। থেইনি ওও নামে একজন বলেন, আইন অনুযায়ী আমাদের একটি নির্বাচন হয়েছে। জনগণ যাকে পছন্দ করে তাকে ভোট দিয়েছে। আমাদের এখন আইনগত আর কোন সুরক্ষা রইল না। আমরা খুবই অনিরাপদ বোধ করছি, আতঙ্ক, উদ্বেগের মধ্যে আছি। ফেসবুকে এনএলডির ভেরিফাইড পেজ থেকে সেনাবাহিনীর হাতে আটক সুচির বরাত দিয়ে একটি বিবৃতি পোস্ট করা হয়েছে। যেখানে তিনি জনগণকে এ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সড়কে বিক্ষোভে নামার আহ্বান জানান। পোস্টে বলা হয়, আটক হওয়ার আগে সুচি এই বিবুতি লিখে যান। অভ্যুত্থানের ফলে জনগণ উদ্বিগ্ন হলেও এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রাস্তায় বিক্ষোভে নামার কোন লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। ছাত্র নেতা সি থু তুন বলেন, আমাদের দেশ একটি পাখির মতো ছিল, যে মাত্র উড়তে শিখছিল। এখন সেনাবাহিনী আমাদের ডানা ভেঙ্গে দিয়েছে। তবে শুধু সেনা অভ্যুত্থানের বিপক্ষে নয় কেউ কেউ পক্ষেও কথা বলছেন। একজন জাতীয় ভিক্ষু ফেসবুকে এক ভিডিও পোস্টে বলেন, আজ জনগণের খুশির দিন।

ফের হুমকিতে গণতন্ত্র:

২০১১ সালে গণতান্ত্রিক সংস্কার শুরুর আগ পর্যন্ত অর্ধশতক মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শাসনেই ছিল। সে সময় দীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দী করে রাখা হয় সুচিকে। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অহিংস লড়াইয়ের জন্য ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। এরপর তার দল এনএলডি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসে ২০১০ সালে মুক্তি পান সুচি। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়ী হয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয় সুচির দল। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সেই সরকারের মেয়াদ শেষে গত বছরের ৮ নবেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে সুচির দল এনএলডি বড় জয় পায়। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ৩২২টি আসনই যথেষ্ট, সেখানে এনএলডি পেয়েছে ৩৪৬টি আসন। তবে সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে। দেশটির নির্বাচন কমিশন অনিয়মের অভিযোগ নাকচ করলেও উত্তেজনা বাড়তে থাকায় মিয়ানমারে ফের সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। মিয়ানমারের সেনবাহিনী এক দশক আগে যে সংবিধান রচনা করেছিল, সোমবারের সামরিক হস্তক্ষেপ সেই সংবিধানেরই সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ গত শনিবারও সেনাবাহিনী সংবিধান মেনে চলার অঙ্গীকারের কথা বলেছিল। সুচির মতো নেতাদের আটক করার ঘটনা উসকানিমূলক এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি পদক্ষেপ, যা তীব্র বাধার মুখে পড়তে পারে।

জরুরী অবস্থা জারি:

প্রেসিডেন্ট ও ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী সুচিসহ শাসক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে আটকের পর এক বছরের জন্য জরুরী অবস্থা জারি করেছেন দেশটির সেনাবাহিনী। আটক অভিযান শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা পর মিলিটারি টিভি বিষয়টি নিশ্চিত করে জানায়, সেনাবাহিনী দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এক বছরের জন্য জরুরী অবস্থা জারি করেছে। মিয়ানমার বার্মা নামেও পরিচিত। ২০১১ সালে গণতান্ত্রিক সরকারের কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অধীনেই দেশটি শাসিত ছিল।

টোকিও-ব্যাংককে বিক্ষোভ:

মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে টোকিও-ব্যাংককে বিক্ষোভ হয়েছে। ব্যাংককে মিয়ানমার দূতাবাসের সামনে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান থাইল্যান্ডে বসবাসরত মিয়ানমারের নাগরিকরা। ক্ষমতাসীন দল এনএলডির নেত্রী সুচির প্রতিকৃতি হাতে টোকিওর ইউনাইটেড ন্যাশনস ইউনিভার্সিটির সামনে বিক্ষোভ করছেন কয়েকশ’ বার্মিজ নাগরিক। এসময় বিক্ষোভকারীরা মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলকে সরব হওয়ার আহ্বান জানান। সুচিসহ আটক রাজনৈতিক নেতাদের ছেড়ে দেয়ার দাবি তোলেন তারা। ব্যাংককে মিয়ানমার দূতাবাসের সামনে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান থাইল্যান্ডে বসবাসরত বার্মিজ নাগরিকরা।

সব ব্যাংক বন্ধ:

সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে সব ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে দুর্বল ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ব্যাংক বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ্যাসোসিয়েশনের ওই ঘোষণায় বলা হয়, মিয়ানমার ব্যাংকস এ্যাসোসিয়েশনের সব সদস্য ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বসম্মতিক্রমে তাদের ব্যাংক বন্ধ করছে। নেটব্লকস নামের এক নাগরিক সংগঠন বলছে, স্থানীয় সময় ভোররাতে টেলিযোগাযোগ ব্যাহত হয়। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। মিয়ানমার ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হওয়ায় দেশটির সব ব্যাংক তাদের সব ধরনের আর্থিক কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব ব্যাংকের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ রাখার বিষয়ে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নেয়া হবে এবং কবে থেকে সব কার্যক্রম আবারও শুরু হবে সে বিষয়টি পরবর্তীতে জানিয়ে দেয়া হবে।

বিশ্ব নেতাদের উদ্বেগ:

মিয়ানমারে যা ঘটছে, তা নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব এ্যান্তোনিও গুতেরেস উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন তার মুখপাত্র স্টিভেন দুজারিক। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের সব পক্ষকেই উসকানিমূলক কোন পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকার এবং গণতান্ত্রিক রীতি মেনে নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি বলেছেন ভোটের ফল নিয়ে কোন বিরোধ থাকলে আইনীভাবেই তা মেটাতে হবে। গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য মিয়ানমারের জনগণের যে আকাক্সক্ষা, জাতিসংঘ তার প্রতি সমর্থন দিয়ে যাবে বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফল পাল্টে দেয়ার বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার যেকোন উদ্যোগের বিরোধিতা করবে বাইডেন প্রশাসন। সুচিসহ আটক নেতাদের মুক্তি দেয়ার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিংকেন। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, শান্তি এবং উন্নয়নের প্রতি মিয়ানমারের জনগণের যে আকাক্সক্ষা, তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে। সামরিক বাহিনীর উচিত এখনি তাদের ওই পদক্ষেপ থেকে সরে আসা। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিজ পেইনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, আইনী প্রক্রিয়ায় বিরোধ মীমাংসা এবং বেসামরিক সব নেতা ও অন্য যাদের বেআইনীভাবে আটক করা হয়েছে, তাদের সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া বিষয়টিকে মিয়ানমারের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তবে মিয়ানমারের প্রধান মিত্র চীনের কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনও আসেনি।

সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া:

মিয়ানমারের গত বছরের সাধারণ নির্বাচনে করা জালিয়াতির প্রতিক্রিয়ায় সরকারের জ্যেষ্ঠ নেতাদের তারা আটক করেছে বলে দেশটির সেনাবাহিনী জানিয়েছে। সামরিক বাহিনী পরিচালিত টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভিডিও ভাষণে বলা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিং অং হ্লাইংয়ের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী সুচি এবং দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের আটক করে সেনাবাহিনী। গত বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে ঘিরে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার ও প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর মধ্যে কয়েকদিন ধরে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার পর এসব ঘটনা ঘটল। ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হবে ॥ মিয়ানমারে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। নতুন সামরিক জান্তার বৈঠক শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বৈঠকের সারাংশ তুলে ধরে জানানো হয়েছে, দেশটিতে সুষ্ঠু ও সত্যিকারের শৃঙ্খলাপূর্ণ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনুশীলনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কমান্ডার-ইন-চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। অবশ্য কবে নাগাদ নির্বাচন দেয়া হতে পারে সে বিষয়ে কোন সময়সীমা জানায়নি মিয়ানমার সেনাবাহিনী। জরুরী অবস্থা জারির পর রাজধানী নেপিডোতে মোবাইল ফোন ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং রেডিওর প্রচার বন্ধ করে দেয়া হলেও সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন মায়াবতির সম্প্রচার চালু রয়েছে। টেলিভিশনটির এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, গত ৮ নবেম্বরের বহুদলীয় সাধারণ নির্বাচনে যে ভোটার তালিকা ব্যবহার করা হয়েছে তাতে গরমিল পাওয়া গেছে। এ বিষয়টির সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশন। এতে আরও বলা হয়, ভোটার তালিকা নিয়ে জালিয়াতি করা হয়েছে, যার ফলে গণতন্ত্র নিশ্চিত সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে অস্বীকৃতি জানানো এবং উচ্চ ও নিম্নকক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে পার্লামেন্ট। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বলছে, এই সমস্যার সমাধান না হলে এটি গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে। আইন অনুযায়ী, এই সমস্যার অবশ্যই সমাধান করতে হবে। এ কারণে ২০০৮ সালের সংবিধানের ৪১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশজুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। আগামী এক বছর এই জরুরী অবস্থা বহাল থাকবে।

রাজধানীতে সেনা টহল:

সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কার মধ্যে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো এবং প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। বড় শহরগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ‘টেকনিক্যাল সমস্যার’ কারণে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। তবে এ অবস্থায় দেশটির ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র মায়ো নিউন্ট বলেছেন, আমি জনগণকে রূঢ়ভাবে প্রতিক্রিয়া না জানানোর অনুরোধ করব। সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার হিড়িক:

সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর ইয়াঙ্গুনের বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই শহরের আশপাশের এলাকাগুলোর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রাখা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখা গেছে। অভ্যুত্থানের খবরে আতঙ্কিত হয়ে মিয়ানমারের মানুষ অর্থ তোলার জন্য এটিএম বুথের সামনে জড়ো হচ্ছেন। অনেক বুথের সামনেই মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মানুষজন এটিএম বুথ থেকে অর্থ তুলতে পারছে না বলে খবর পাওয়া গেছে। ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারা এর মধ্যেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। অনেকেই বাইরে বের হয়ে শুকনো খাবার কিনতে শুরু করেছেন। তবে বিভিন্ন দোকানে চাল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিয়ে অনেকে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। ইয়াঙ্গুনের আঞ্চলিক পার্লামেন্ট এবং আঞ্চলিক সরকারী অফিসগুলোর দখল নিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। বেসামরিক কর্মকর্তাদের এসব দফতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ইয়াঙ্গুনে সেনা অভ্যুত্থানের সমর্থনে উল্লাস করেছে স্বঘোষিত কিছু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা। তারা সুয়োডাগন প্যাগোডার বাইরে শহীদদের সমাধিস্থলের কাছে গান গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। এই দলের একজন জানিয়েছেন যে, উদ্যাপনের অংশ হিসেবে তারা শহরের অন্য স্থানগুলোতেও যাবেন। কয়েকদিন ধরেই জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা সামরিক বাহিনীর সমর্থনে ইয়াঙ্গুনের বিভিন্ন স্থানে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণই রয়েছে। এর পাল্টা কোন বিক্ষোভ কিংবা অভ্যুত্থানবিরোধী কোন বিক্ষোভ এখনও অনুষ্ঠিত হয়নি।

সরকারী টেলিভিশন-রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ:

সোমবার স্থানীয় সময় ভোরে সামরিক অভিযান চলার সময় প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোতে মোবাইল ফোন ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং রেডিওর সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া পোস্টে মিয়ানমার রেডিও এবং টেলিভিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আমরা আপনাদের জানাতে চাই যে, এমআরটিভি এবং মিয়ানমার রেডিওর সম্প্রচার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। সরকারী দলের মুখপাত্র মায়ো নিউন্ট গণমাধ্যমকে বলেন, এটি একটি সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। কিন্তু তারা (সেনাবাহিনী) চাইলে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রেসিডেন্টকে জরুরী জাতীয় নিরাপত্তা সভা ডাকতে বাধ্য করে এটা অস্বীকার করতে পারেন। সংবিধান অনুযায়ী, শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টই জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন। বর্তমানে শুধুমাত্র সেনাবাহিনী পরিচালিত মায়াবতি চ্যানেলের সম্প্রচার চালু আছে। আর নির্দিষ্ট এলাকা বাদে বন্ধ রয়েছে মোবাইল ফোন পরিষেবাও।-জনকন্ঠ