বিশেষ প্রতিনিধি
পিলখানায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মামলায় উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদনের প্রক্রিয়া চলছে আসামিদের। তবে হাইকোর্টের দেয়া ২৯ হাজার পৃষ্ঠা রায়ের প্রত্যায়িত কপি নিয়ে আপিলের একেকটি পেপারবুক প্রস্তুত করতে আসামিদের প্রায় ১৬ লাখ টাকা খরচ লাগতো, যা বহনে অক্ষম অনেকেই।
এ অবস্থায় রায়ের অনুলিপির কপি ও পেপারবুক প্রস্তুত মওকুফ করতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে আবেদন করা হয়। আবেদন করেন সংশ্লিষ্ট ‘অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড’ তৌহিদ হোসেন। মানবিক দিক বিবেচনায় প্রশাসনিক আদেশে সম্প্রতি সেটি মওকুফ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। ফলে পিলখানা হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা আপিলে পেপারবুক তৈরির বিরাট খরচ থেকে রেহাই পাচ্ছেন।
যে আপিলের খরচ আগে ১৬ লাখ টাকার মতো হয়েছে, এখন আমরা আইনজীবীরাও যদি কনসিডার করি, তাহলে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় আপিল হতে পারে
প্রধান বিচারপতির এই পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করছেন আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে আর্থিক অনটন ও চাকরিহীন অবস্থায় জেলে থাকা আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা সহজ হয়ে গেল। প্রশস্ত হলো ন্যায়বিচারের পথ।
জানা গেছে, প্রথম দিকে অল্প ক’জন আসামি আপিলের প্রক্রিয়া শুরু করলেও প্রধান বিচারপতির পেপারবুক মওকুফের পরে শতাধিক আসামির পক্ষে আপিল করা হয়েছে। আরও যারা আপিল করবেন, সকলেই পেপারবুক মওকুফের এই সুযোগ পাবেন।
সুপ্রিম কোর্ট ও আসামিপক্ষের আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি আপিল ৬০-৬৬ হাজার পৃষ্ঠার মতো। হাইকোর্টের ২৯ হাজার পৃষ্ঠার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেতে খরচ দাঁড়ায় তিন থেকে চার লাখ টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে সর্বমোট ব্যয়ের অঙ্ক দাঁড়াচ্ছিল ১৬ লাখ টাকা।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে, হাইকোর্টের রায়ের অনুলিপি একজনকে দিতেই তাদের (সুপ্রিম কোর্টের) সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মচারীকে মাসজুড়ে ফটোকপি করতে হয়েছে। আবার মামলায় আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এতো সংখ্যক আপিলের নথিপত্র রাখার স্থান সংকুলান নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। এখন সেই শঙ্কাও দূর হয়েছে।
পিলখানা হত্যা মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘একটি আবেদনে পূর্ণাঙ্গ পেপারবুক দিয়ে আপিল ফাইল করেছি। সেটার মধ্যে হাইকোর্টের জাজমেন্ট, লোয়ার কোর্টের (বিচারিক আদালত) জাজমেন্ট, ৬৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য, এজাহার ও চার্জশিটসহ যা যা লাগে, সমস্ত কিছু দিয়ে নয়জন আসামির পক্ষে আপিল করেছি। প্রথম আপিলে সব মিলিয়ে মোট ৬৬ হাজার পৃষ্ঠা হয়েছে। এতে প্রায় ১৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’
‘আপিলটি করার পর প্রধান বিচারপতির কাছে একটি দরখাস্ত করেছি, অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড তৌহিদ হোসেনের মাধ্যমে। সেখানে আমাদের বিষয়বস্তু ছিল যেহেতু এক নম্বর আপিলে আমরা সমস্ত কাগজপত্র জমা দিয়েছি, সেই কাগজপত্রগুলোর দরখাস্ত দিয়ে আমাদের অন্যান্য আপিল যেন ফাইল করার সুযোগ দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি একটি প্রশাসনিক আদেশে আবেদনটি মঞ্জুর
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘যেহেতু প্রধান বিচারপতি আমাদের অনুমতি দিয়েছেন, তাই আপিলে এতো পেপার আর লাগবে না। এখন শুধু মেমো, অর্থাৎ যে দরখাস্ত সেটা এবং আনুষঙ্গিক এক থেকে দেড়শ’ পাতার কাগজপত্র লাগবে। তাতে আইনজীবীর ফি এবং অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হবে। এখন যে আপিলগুলো হচ্ছে তাতে ওই কপি আর লাগবে না। এক নম্বর আপিলের পেপারবুক ব্যবহার করে সব আপিলই করা সম্ভব হবে। আইনজীবী হিসেবে ২৫টি আপিল করেছি, তার মধ্যে আনুমানিক দেড়শ’ আসামির পক্ষে আবেদন করা হয়েছে।’
মামলার আদ্যোপান্ত
{২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর} সদরদফতরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ করে সীমান্তরক্ষী বাহিনীটির একদল বিপথগামী সদস্য। তারা সেদিন পিলখানায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়, বিদ্রোহ গড়ায় পরের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারিও। দুই দিনব্যাপী বিদ্রোহ শেষে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সে বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে আলাদা মামলা হয়, যা পরে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়। মামলায় আসামি ছিল ৮৫০ জন।
দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এছাড়া সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় ২৫৬ জনকে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন।
পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি। ৩৭০ কার্যদিবস শুনানির পর ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে বিচারিক (নিম্ন) আদালতে মৃত্যুদণ্ডিত ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। আটজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং চারজনকে খালাস দেয়া হয়। এছাড়া আরেকজন বিচার চলাকালে মারা যান।
বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬০ জনের মধ্যে হাইকোর্ট ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন। ১২ জনকে খালাস দেন। বিচার চলাকালে মৃত্যু হয় দুজনের।
বিচারিক আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ২৫৬ জনের মধ্যে ২২৫ জনের ক্ষেত্রে আপিল হয় হাইকোর্টে। তাদের মধ্যে দুইজনের দুটি ধারায় মোট ১৩ বছর (১০+৩) করে, ১৮২ জনের ১০ বছর, আটজনের সাত বছর, চারজনের তিন বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। হাইকোর্টে খালাস পান ২৯ জন। ২৮ জনের বিষয়ে আপিল না হওয়ায় তাদের আগের ক্ষেত্রে জজ আদালতের দেয়া কারাদণ্ড বহাল থাকে। বাকি তিনজন কারাগারে মারা যান।
হাইকোর্টের ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় গত ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি। রায়ের অনুলিপি প্রকাশের পর শুরু হয় আপিল বিভাগে আবেদন করার প্রক্রিয়া। তারই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপক্ষ খালাসপ্রাপ্তদের দণ্ড চেয়ে আপিল করে। আর আসামিপক্ষ দণ্ডপ্রাপ্তদের খালাস চেয়ে আপিল শুরু করে।
খালাসপ্রাপ্ত ৭৫ জনসহ ৮৩ আসামির সাজা বাড়ানোর জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডের পর হাইকোর্টে খালাস পাওয়া চারজনের ক্ষেত্রে ১৭ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অপর ৭৯ জনের ক্ষেত্রে ২২ ডিসেম্বর পৃথক ১৯টি লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অর্থাৎ মামলায় ৮৩ জনের বিষয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক ২০টি লিভ টু আপিল করে।jagonews24পিলখানার নারকীয় হতাযজ্ঞে প্রাণ হারান ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তা, এমনই এক সহকর্মীর কফিন ধরে কান্না
পেপারবুক মওকুফে যা বলছেন আইনজীবীরা
অ্যাডভোকেট মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘যে আপিলের খরচ আগে ১৬ লাখ টাকার মতো হয়েছে, এখন আমরা আইনজীবীরাও যদি কনসিডার করি, তাহলে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় আপিল হতে পারে।’
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আমরা রেগুলার পিটিশন একটা ফাইল করেছি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। ফাইলটি করেছি যাদের রিলিজ করে, খালাস দিয়েছে তাদের একুইটালের অ্যাগেইনেস্টে। আসামিরাও কিছু ফাইল করেছে, এখন বাকি আসামিরা দরখাস্ত করছে। আসামিদের একটা আবেদনে ৬০ হাজার পৃষ্ঠার মতো হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি সেটি মওকুফ করার ফলে এখন আর সবাইকে পেপারবুক প্রস্তুত করতে হবে না। এই মহতী উদ্যোগের ফলে আসামিরা বিরাট অঙ্কের টাকা খরচ থেকে রক্ষা পেল।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের একজন অ্যাডভোকেট আপিল ফাইল করেছেন কয়েকজন আসামির পক্ষ থেকে। এরপর আসামিপক্ষ থেকে পেপারবুক প্রস্তুতের জন্য ফি মওকুফের আবেদন করা হয়েছে। সেটি খুব ভালো এবং ইতিবাচক দিক। প্রধান বিচারপাতির উদ্যোগের ফলে গরিব আসামি যারা আছেন, তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথও সুগম হবে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করার সুযোগকে প্রশস্ত করবে। প্রধান বিচারপতির একটি ভালো সিদ্ধান্তে তাদের পেপারবুক করার খরচটা মাফ করে দিয়েছেন। এটা খুবই ইতিবাচক।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিলের পেপারবুক প্রস্তুতি মওকুফ করে প্রধান বিচারপতির নেয়া উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। মানবিক বিবেচনায় এটা প্রধান বিচারপতির অত্যন্ত ভালো সিদ্ধান্ত।’- জাগো নিউজ