বীর চট্টলা চালাবে কে

2
Spread the love

“ আজ চসিক নির্বাচনের ভোট : উৎসবের সঙ্গে আছে উৎকণ্ঠাও”

খুলনাঞ্চল রিপোর্ট

৬০ বর্গমাইল আয়তনের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র পদটির হাল আমলে গুরুত্ব কমেছে অনেক। সবশেষ দুই মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও মনজুর আলম মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পাননি। এর পরও চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার প্রশাসনের সবচেয়ে জৌলুসপূর্ণ পদটির নাম মেয়র। পাহাড়, সাগর ও সমতল- এ তিনের সমন্বয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বীর চট্টলাখ্যাত এ নগরের মেয়র কে হবেন তা আজ বুধবার নির্ধারণ করবেন ১৯ লাখের বেশি ভোটার। প্রচারকালের সহিংসতা, প্রাণহানি এবং প্রধান দুই প্রার্থীর পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যেও এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার আশা, উৎসবমুখর পরিবেশেই হবে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম।

বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন সময় আপত্তি জানালেও চসিক নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হবে। মেয়র পদে ৭ জন লড়লেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের মধ্যে।

৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৯টিতে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৭২ জন এবং ১৩টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৫৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একটি ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। নগরীর আলকরণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিম মৃত্যুবরণ করায় সেখানে কাউন্সিলর নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। চসিকের ভোটার ১৯ লাখ ১৭ হাজার ৯৭৮। ভোট নেওয়ার দায়িত্বে থাকছেন ৭৭৫ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ৪৮৮৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং ৯ হাজার ৭৭২ জন পোলিং অফিসার। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) সূত্র জানায়, অতীতের নানা সংঘাত এবং সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও উত্তেজনা বিবেচনায় ৪১০টি ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এ ছাড়া ১২টি ওয়ার্ডকেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন। এগুলো হলো- ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী, ২ নম্বর জালালাবাদ, ৩ নম্বর পাঁচলাইশ, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী, ১৪ নম্বর লালখান বাজার, ১৬ নম্বর চকবাজার, ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর, ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ও ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গিবাজার।

এসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থীরাও স্থানীয় রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী। আবার ৯টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সদ্য সাবেক কাউন্সিলর। ফলে মাঠ পর্যায়ের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনেও রয়েছে তাদের প্রভাব। এর মধ্যে ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও সদ্য সাবেক কাউন্সিলর আবদুল কাদের বর্তমানে কারাগারে আছেন। গত ১৩ জানুয়ারি পাঠানটুলি এলাকায় আবদুল কাদের ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সমর্থকদের সংঘর্ষে আজগর আলী বাবুল নামের এক মহল্লা সর্দার নিহত হন। এ ঘটনায় আবদুল কাদেরসহ ১২ জন কারাগারে রয়েছেন।

বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীর টানা অভিযোগ এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে সরকারি দল সমর্থিত ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা সত্ত্বেও নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন চসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান। তিনি গতকাল মঙ্গলবার সবশেষ প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, পুরো নির্বাচনী এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে ৭ হাজার ৭৭২ জন পুলিশ, ২৫ প্লাটুন বিজিবি ও র‌্যাবের ৪১টি টিম নিরাপত্তা রক্ষার কাজ করবে। আশা করি কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।

চসিক নির্বাচন উপলক্ষে এবার সিটি এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন। সম্প্রতি একটি সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেন, ভোট দেওয়ার জন্য ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু ভোটাররা বন্ধ পেয়ে বাড়িতে চলে যান। ফলে সাধারণ ছুটি দেওয়া হয়নি। সিইসির যুক্তি মানতে নারাজ ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। তার অভিযোগ, ভোটার উপস্থিতি কমাতে ছুটি দেওয়া হয়নি। সরকারি দলের ইশারায় নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। এ অভিযোগের সঙ্গে একমত হাতপাখা প্রতীকের মেয়র পদপ্রার্থী ইসলামী আন্দোলনের জান্নাতুল ইসলাম। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি না করে মানুষে ভোট দিতে আসবে কোন দুঃখে? তিন দিন আগে আমি সাধারণ ছুটি চেয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দরখাস্ত দিয়েছি। কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

চট্টগ্রাম বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুলিশ গত এক সপ্তাহে দলের নেতাকর্মীদের নামে ১৫টি মামলা, মেয়র প্রার্থীর ৫৬ জন নির্বাচনী এজেন্টসহ দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া নির্বাচনী এজেন্টদের তালিকা ধরে তাদের বাসায় গিয়ে ভয়ভীতি ও হুমকি ধমকি দিচ্ছে। এ বিষয়ে শাহাদাত হোসেন বলেন, আমার এজেন্টরা এক সপ্তাহ ধরে ঘরে থাকতে পারছে না। তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পুলিশ অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় বিএনপিকে নিয়ে নয় বরং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের নিয়েই। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে এরই মধ্যে দুজন খুন হয়েছেন। দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর লালখান বাজার ওয়ার্ডে নির্বাচনী প্রচার বর্জনও করেন মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী।

ভোটের আগের দিন গতকাল দুই প্রধান মেয়র পদপ্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ও শাহাদাত হোসেন নিজ বাড়িতেই সময় কাটান। তারা নেতাকর্মী, শুভাকাঙ্খী ও গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। রেজাউল বলেন, জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের কারণে জনগণের কাছে আমি অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। তিনি বিএনপি নেতা শাহাদাতকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আখ্যা দিয়ে বলেন, তাকে কখনো হালকাভাবে নিইনি।

ভোটকেন্দ্রে পৌনে হাজার পুলিশ

নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রগুলোতে পাহারায় থাকবে ৭ হাজার ৭৭২ জন পুলিশ সদস্য। ইতোমধ্যে ৪০০ বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। গত সোমবার বিকাল থেকে বিজিবির গাড়িগুলো নগরীর বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে।

সিএমপির কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর গতকাল বিকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নগরের বিভিন্ন এলাকায় আমরা চেকপোস্ট করেছি। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বিশেষভাবে নজর রাখা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় বিভিন্ন কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ছয়জন পুলিশ মোতায়েন করা হবে। এর বাইরেও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা থাকবেন।

তিনি বলেন, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমরা যে রকম আশঙ্কা করেছিলাম তা রুখতে পেরেছি। আমরা জানিয়ে দিতে চাই, যাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকবে তাদের জন্য উৎসবমুখর হবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কিন্তু যাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র থাকবে না তাদের জন্য মানে বহিরাগতদের জন্য দ্বার বন্ধ। কোনো বহিরাগত এসে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।