স্টাফ রিপোর্টার
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনে সংহতি প্রকাশের অপরাধে ৩ শিক্ষককের বিরুদ্ধে সিণ্ডিকেটে শাস্তি চূড়ান্ত। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে চাকুরি থেকে বরখাস্ত এবং দুইজন শিক্ষককে চাকুরি থেকে অপসারণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বরখাস্তকৃত শিক্ষক হলেন বাংলা ডিসিপ্লিনের সহকারী শিক্ষক মো. আবুল ফজল। অপসারণকৃত শিক্ষকদ্বয় হলেন ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরী ও বাংলা ডিসিপ্লিনের প্রভাষক শাকিলা আলম।
বরখাস্তের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে মো. আবুল ফজল বলেন, বর্তমান ভিসি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি একটি পাতানো খেলা। এই ভিসির ভবন নির্মান-দুর্নীতি, নারী প্রার্থীতে যৌন হয়রানি করাসহ নানাবিধি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে উপাচার্য এ ব্যক্তিগত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ করলেন। তিনি বলেন, গত বছরের ১৩ অক্টোবর আমাকে প্রথম চিঠি দেওয়া হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য চিঠি দিয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা চিঠির মাধ্যমে জানতে আমি জানতে চেয়েছি। কিন্তু কোনও ধরনের তথ্য আমাকে সরবরাহ করা হয়নি। আমাকে ডাকা হয় গত ১০ ডিসেম্বর। কিন্তু তার ২দিন আগে অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর সমস্ত স্বাক্ষির স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। যা আমার অনুপস্থিতিতেই করা হয়। জুডিশিয়াল নিয়ম অনুযায়ী অভিযুক্তর উপস্থিতিতেই স্বাক্ষ্য গ্রহণ করার বিধান। কিন্তু তা করা হয়নি। তবুও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমস্ত অনুলিপি চাওয়া হলেও তা পাইনি।
তিনি আরও বলেন, পাতানো খেলায় চাকরিচ্যুত করা গেলেও শিক্ষকত্ব কেড়ে নেওয়া যায় না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি না। একটি ব্রত নিয়ে এ মহান পেশায় নিয়োজিত। তাই, আমার ব্রত থেকে কখনই বিচ্যুত হব না।
২৩ জানুয়ারি বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ২১২তম সভায় এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসহ আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সভায় স্থান পায়। সূত্রে জানা গেছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েও তিন শিক্ষক তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা বা দুঃখ প্রকাশ না করায় এবং অবাধ্যতা, গুরুতর অসদাচারণ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন বিরোধী কার্যক্রম ছাড়াও একাধিক অভিযোগ সন্দেহাতীতকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধন্ত চূড়ান্ত করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র ও সিন্ডিকেট সচিব ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস জানান, উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের সভাপতিত্বে সিন্ডিকেট সভায় উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মোসাম্মাৎ হোসনে আরা, নতুন সদস্য প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ ওয়াহিদা আক্তার, প্রফেসর ড. মো. মনিরুল ইসলাম, প্রফেসর এ কে ফজলুল হক, প্রফেসর ড. মো. আব্দুল জব্বার, ড. নিহার রঞ্জন সিংহকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। এছাড়া সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন, প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা, প্রফেসর ড. মো. মাহবুবুর রহমানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্যাটাগিরর অন্যান্য সকল সদস্য সভায় উপস্থিত ছিলেন। সিন্ডিকেটের অপর দুই সদস্য খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য বর্তমানে ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর ও খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি অনলাইনে যুক্ত থেকে এ সভায় অংশগ্রহণ করেন।
সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান ফটক স্থাপনের নকশাও গৃহীত হয়। এছাড়া উপাচার্য ফিতা কেটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে একটি আর্কাইভয়ের উদ্বোধন করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার, সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সিন্ডিকেট সদস্যদের অনেকেই গত দশ বছরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধমে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এবং উপাচার্য হিসেবে তার ধৈর্য, নিষ্ঠা, আন্তরিকতার জন্য তাকে অন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। উপাচার্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার দুই মেয়াদ মিলিয়ে দশ বছর দুই মাস সময়ে দায়িত্ব পালনে সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দের অঅন্তরিক সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন এই দীর্ঘ সময়ে কাজ করতে যেয়ে তিনি সব সময়েই সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ দেখেছেন। সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি কোয়ালিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চেষ্টা করেছেন।
তার কর্মকালে সিন্ডিকেট সভায় অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসবই বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে। তবে তিনি বলেন মানুষ হিসেবে আমরা ভুল করতেই পারি। কিন্ত সেই ভুলের জন্য দুঃখবোধ বা অনুশোচনা থাকাটা জরুরি। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনে সামনে এগোতে হয় এটাই জীবনের বাস্তবতা।
এর আগে গত ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ২১১তম সভার সিদ্ধান্তে উক্ত তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে নিয়মানুযায়ী রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাদের নিজ নিজ নামে কেনও তাদেরকে বরখাস্ত এবং অপসারণ করা হবে না বলে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পত্র দেওয়া হয়। অভিযুক্ত তিনজন নির্ধারিত ২১ জানুয়ারি দুপুর মধ্যে উক্ত পত্রের জবাব প্রদান করেন। তবে সূত্রে জানা গেছে তিনজন শিক্ষক জবাব দিলেও তারা কোনওরকম দুঃখ বা ক্ষমা প্রকাশ করেননি। নিয়মানুযায়ী ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ২১২তম সভায় পূর্ববর্তী ২১১তম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত এবং তিন শিক্ষককে দেওয়া আত্মপক্ষ সমর্থনে জবাব নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনা করা হয়। শেষে সিন্ডিকেট তাদের চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত এবং অপসারণের সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়।
অন্যদিকে, নিজেদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় রয়েছেন দুই শিক্ষার্থী। শনিবার ৬ষ্ঠ দিনের মতো আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন তাঁরা। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় দুজনকেই স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। শুক্রবার বেলা দুইটার দিকে অনশনরত শিক্ষার্থী ইমামুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে অনশনরত মোহাম্মদ মোবারক হোসেন ওরফে নোমান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকেও স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়।
মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। ইমামুল ইসলাম ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের শিক্ষার্থী। গত ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাতটা থেকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে ৪৮ ঘন্টা ও ১৯ জানুয়ারি থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১ ও ২ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন করে। এ সময় শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ, তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা না করাসহ বিভিন্ন কারণে ওই দুই শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বোর্ড। ওই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে তারা আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফিস কমানো, আবাসন সংকট নিরসনসহ ৫ দফা দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীর সঙ্গে ইমামুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মোবারকও আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ওই সময় দুই শিক্ষকের সঙ্গে অসদাচরণ করার অভিযোগ তোলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। তবে ওই দুই শিক্ষার্থী দাবি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ ভিত্তিহীন ও প্রহসনমূলক।