কূটনৈতিক সাফল্য ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ

4
Spread the love

মো. তৌহিদুল ইসলাম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ৬ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে টানা ১২ বছর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছে। এ সময়ে পররাষ্ট্র বিষয়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে এ সরকার। সেই সাথে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উন্নতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়; বঙ্গোপসাগরে ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র-এলাকার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অব্যাহত ও ঐকান্তিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অবিসংবাদী ভাষণ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ পর্যন্ত ৩৩৮ জন বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান করা হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারত স্থলসীমানা চুক্তি ১৯৭৪-এর প্রটোকল স্বাক্ষর এবং ২০১৫ সালে স্থলসীমানা চুক্তির অনুসমর্থন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদীর্ঘ প্রচেষ্টারই সুফল। ইন্সট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশন এবং লেটার অব মোডালিটিস স্বাক্ষরের মাধ্যমে তৎকালীন ১১১টি ভারতের ছিটমহল বাংলাদেশের এবং আমাদের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে এর আগে নাগরিকত্বহীন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নাগরিকত্ব লাভ করে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিতকল্পে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি ‘করোনা সেল’ স্থাপিত হয়ছে। বিভিন্ন সংস্থার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে আটশ’র অধিক বিশেষ ফ্লাইটে করোনায় লকডাউনে বিদেশে আটকা পড়া বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীসহ প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার বাংলাদেশির দেশে প্রত্যাবর্তন এবং বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় ৩০ হাজার  বিদেশি নাগরিকের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। মিশনসমূহের নিরলস প্রচেষ্টা ও সরকার ঘোষিত প্রণোদনার ফলে কোভিড-১৯ আপদকালীন সময়েও ২০২০ সালের জানুয়ারি হতে নভেম্বর পর্যন্ত রেকর্ড পরিমাণ ১৯.৬৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স প্রবাসীরা দেশে প্রেরণ করেছে।

বাংলাদেশ আগামী দু’বছরের (২০২০-২০২২) জন্য ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (CVF)-এর চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি Global Centre on Adaptation-এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয় বাংলাদেশে স্থাপন করা হয়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে শান্তিরক্ষী প্রেরণের সংখ্যায় প্রথম স্থান পুনরুদ্ধার করে। সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’ প্রবর্তনের একটি প্রস্তাব ইউনেস্কো কার্যনির্বাহী বোর্ডের সভায় সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে।

গত ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ-ভুটান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ভুটানের মাঝে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা পিটিএ (প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট) স্বাক্ষরিত হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের ভার্চুয়াল দ্বিপাক্ষিক সামিট অনুষ্ঠিত হয়। এই সামিটে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৭টি দ্বিপাক্ষিক দলিল স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মাধ্যমে দুই প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়েছে।

ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী’’ গ্রন্থটি ১৩টি ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া আরও ০৬ টি ভাষায় গ্রন্থটি অনুবাদ ও প্রকাশনার কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া, বঙ্গবন্ধু রচিত “কারাগারের রোজনামচা” গ্রন্থটি ইতোমধ্যে অহমীয়া ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং হিন্দি ও নেপালী ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশনার কাজ চলমান রয়েছে।

মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে নাইজেরিয়াস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের উদ্যোগে নাইজেরিয়ান পোস্টাল সার্ভিসের একটি স্মারক ডাকটিকেট বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিওফ্রে অনিইয়েমা ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গত ২৭ আগস্ট ২০২০ তারিখে অবমুক্ত করেন। ২০১৮ সালে থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ স্থাপন করা হয়।

মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে কম্বোডিয়ার রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে সড়ক নামকরণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মরিশাসের রাজধানী পোর্ট লুইসে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি সড়ককে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্ট্রিট’ নামকরণ করা হয়।

গত ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ কর্তৃক উত্থাপিত “শান্তির সংস্কৃতি’’ রেজ্যুলেশন সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ বছর বিশ্বের ১২৬টি দেশ বাংলাদেশের এই রেজ্যুলেশন কো-স্পন্সর করেছে যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। গত ২০ বছরের এই রেজ্যুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়া প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

বাংলাদেশ মানবিক কারণে মিয়ানমারের ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলিতে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ, ভূমিধস এবং অন্যান্য অনিয়ন্ত্রিত ঘটনার ফলে মৃত্যুর যে কোনো ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশ সরকার পর্যায়ক্রমে ১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে আগ্রহী তাদের সেখানে নেওয়া হচ্ছে। দ্বীপটি উন্নয়নে সরকার ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। গত বছরের ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক আদালত (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস)-এ মামলা করে গাম্বিয়া এবং এই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয় গত ১০ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে। শুনানিতে বাংলাদেশ তথ্য এবং আনুষঙ্গিক সহযোগিতা প্রদান করে।

১৯৯৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডক্টর অব ল ডিগ্রি প্রদান করে। সে বছরের ২৫ অক্টোবর তিনি যুক্তরাজ্যের Abertay Dundee বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি সম্মাননায় ভূষিত হন। আন্তর্জাতিক লায়ন্স ক্লাব কর্তৃক ১৯৯৬-৯৭ সালে ‘‘Medal of Distinction’’ পদক ও ১৯৯৬-৯৭ সালে ‘Head of State’ এবং ১৯৯৮ সালে ‘‘Medal of Distinction’’ সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি।

১৯৯৮ সালে সর্বভারতীয় শান্তিসংঘ থেকে “মাদার তেরেসা’’ পুরস্কার পান। একই বছর মহাত্মা গান্ধী ফাউন্ডেশন কর্তৃক ‘‘এম কে গান্ধী পুরস্কার’’ এবং ইউনেস্কো হতে হূপে-বোয়ানি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দেসিকোত্তম’ (ডক্টর অব লিটারেচার, হনোরিস কাউজা) ডিগ্রি এবং সে বছরের ২০ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি পান তিনি।

২০০০ সালের ০৪ ফেব্রুয়ারি ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস হতে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই বছর রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত হন। ২০০০ সালের ৯ এপ্রিল র‌্যানডলফ ম্যাকন উইমেন্স কলেজ (বর্তমান নাম র‌্যান্ডলফ কলেজ) কর্তৃক পার্ল এস. বাক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ব্রিজপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ২০০৯ সালে ‘‘ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার’’ এবং কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ‘ইন্দিরা গান্ধী গোল্ড প্লেক’ পুরস্কারে ভূষিত হন। সে বছরই ইন্দিরা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে ‘‘ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার’’ লাভ করেন।

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি হতে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক ‘Global Diversity Award’ এবং প্যারিসের ডাওফি বিশ্ববিদ্যালয় হতে গোল্ড মেডেলসহ ডিপ্লোমা এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি তাকে ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক  ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি তাকে সনদ প্রদান করে। ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “ডক্টর অব দ্য ইউনিভার্সিটি’’ ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১৮ সালের ২৬ মে পশ্চিমবঙ্গের কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লিটারেচার (ডি-লিট)’ ডিগ্রী পান তিনি। বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ২০১৮ সালে Tagore Peace Award এবং ২০১৯ সালে ড. কালাম স্মৃতি ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।

–                                               পিআইডি ফিচার

লেখক : উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।