ঢাকা অফিস
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে চলতি বছরে ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে হরতালের ডাক দিয়ে বছর শুরু করলেও দলে অভ্যন্তরীণ বিভেদ দিয়ে বছর শেষ করেছে বিএনপি। এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে প্রায় ৭ মাস (২২ মার্চ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) বন্ধ ছিল দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম ও গঠন এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। তবে এই সময় শুধু গরিব-অসহায় মানুষকে সহযোগিতা, ভার্চুয়াল বৈঠক, আলোচনা সভা এবং সংবাদ সম্মেলন করেছে দলটি।
পরবর্তীতে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে দলটি শুধু রাস্তায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ এবং সভা-সেমিনার করেছে। সুতরাং এক কথায় বলা যায়, ২০২০ সালে দলীয় বড় কোনো অর্জন না থাকলেও বছর জুড়ে কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ব্যাপকভাবে বিরাজমান ছিল।
তবে চলতি বছরে ২৫ মার্চ দলটির একটি বড় অর্জন রয়েছে। এইদিন (৭৭৬ দিন পর) মুক্তি পান দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যদিও এটা বিএনপির দলীয় কোনো অর্জন নয়। কারণ বিএনপির আন্দোলনে কিংবা চাপে বেগম জিয়াকে মুক্তি দেয়নি সরকার। বরং বয়স বিবেচনা ও মানবিক কারণে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
এদিকে, গেল ১০ অক্টোবর ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের কর্মী ও সমর্থকরা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উত্তরায় বাসার সামনে বিক্ষোভ করেন। এসময় বিক্ষুব্ধরা মহাসচিবের বাসায় ইটপাটকেল ও ডিমও ছুঁড়ে মারেন।
এর আগে গেল ১২ সেপ্টেম্বর চার শূন্য আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ঢাকা-১৮ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা যখন সাক্ষাৎকারে তখন তাদের সমর্থকরা সংঘর্ষ ও মারামারিতে লিপ্ত হয়। এই আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন এবং কফিল উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন। একজন কর্মীর মাথা ফেটে যায়।
অন্যদিকে, বিএনপির অভ্যন্তরে চলছে নানা মতবিরোধ। জুনিয়ররা যেমন সিনিয়রদের কথা শুনছেন না, তেমনি সিনিয়ররাও জুনিয়রদের মূল্যায়ন করছেন না। নেতাকর্মীরা শুধু একে অপরের ক্ষতি করার জন্য ব্যস্ত থেকেছেন। এজন্য দলটি সরকার হটানোর আন্দোলনে সফল হতে পারেননি বলে মনে করছেন অনেকে।
এবিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ঘরোয়া খেলা (দলের অভ্যন্তরে) বন্ধ না হলে সরকার হটানোর আন্দোলনে সফলতা আসবে না। আর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য যে দল গঠন করেছিলেন তার সেই রেখে যাওয়া দল ৪২ বছর পরে মানসিক ও সাংগঠনিকভাবে খণ্ড-বিখণ্ড। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। আর আমরা ওপেন মাঠে খেলতে পছন্দ করি না, ঘরোয়া খেলতে পছন্দ করি। ঘরোয়া খেলা মানে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে লাগা, একজন আরেকজনকে খাটো করা এবং একজন আরেকজনকে ব্যর্থ করা। আর এই কারণেই গত ১২ বছরে বিএনপি আন্দোলনে সফল হতে পারেনি।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এজন্য গেল ২৬ নভেম্বর স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম।
১৩ নভেম্বর: ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনে উপনির্বাচনে ফলাফল বাতিল এবং নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দুদিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। কর্মসূচির বিষয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের নরমাল যে পদ্ধতি এর কোনো কিছুর সুযোগ পর্যন্ত তারা রাখেনি। সবচেয়ে বড় কথা পুলিশ এসব অপকর্মে সহযোগিতা করেছে। আওয়ামী লীগ নানা মিথ্যাচার করবে এই নির্বাচনকে জাস্টিফাই করার জন্য। কিন্তু কোনোভাবে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
১০ অক্টোবর: ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের কর্মী ও সমর্থকরা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উত্তরায় বাসার সামনে বিক্ষোভ করছে। এসময় বিক্ষুব্ধ কর্মী ও সমর্থকরা বিএনপি মহাসচিবের বাসায় ডিম ও ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারেন। তবে দলটির দাবি, সারাদেশে গুম, খুন, নারী ও শিশু নির্যাতনের যে মহামারী চলছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নিতেই সরকারের এজেন্টরা এ হামলা চালিয়েছে। অবশ্য সরকারকে দোষারোপ করলেও পরবর্তীতে ফখরুলের বাসায় ডিম নিক্ষেপের ঘটনায় ঢাকা মহানগর বিএনপির ১২ নেতাকে বহিষ্কার করে দলটি।
২০ সেপ্টেম্বর: বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সারাদেশে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০ সেপ্টেম্বর দলীয় কার্যক্রমের অগ্রগতির জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।
১২ সেপ্টেম্বর: ঢাকা-১৮ আসনের ধানের শীষের মনোনয়ন প্রত্যাশী এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন এবং কফিল উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
১৫ আগস্ট: এইদিন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ৭৬তম জন্মদিন ছিল। এ উপলক্ষে প্রতি বছর কেক কেটে উদযাপন করে বিএনপি। তবে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের দিনে জন্মদিন পালনের বির্তক থেকে বেরিয়ে আসতে এবছর কেটকাটা থেকে পিছু হটে বিএনপি। তবে খালেদা জিয়ার জন্য ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল আয়োজন করা হয়। তবে দল থেকে বলা হয়, চেয়ারপারাসনের জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। যদিও সিনিয়র নেতারা বলছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুরর শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের দিনে জন্মদিন পালনের বির্তক থেকে বেরিয়ে আসতেই এই কৌশল নেয় দলটি।
১১ জুলাই: বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে দেশি-বিদেশির চাপ, নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় দুই দলের সম্পর্কের ওপর দিয়ে বয়ে গেলেও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়েনি বিএনপি। তবে এবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জামায়াতকে ছাড়ার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়। আর রাজনৈতিক মহলেও আলোচনা উঠে এবার বিএনপি জামায়তকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটি জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেয়নি। আর এবিষয়ে দলটি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
২৫ মার্চ: ৭৭৬ দিন পর চলতি বছরে ২৬ মার্চ মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এইদিন বিকেল সোয়া ৪টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। সেখান থেকে বেগম জিয়া সরাসরি রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের ‘ফিরোজা’ নিজ বাড়িতে গিয়ে উঠেন। পরে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যদের আবেদনে তার মুক্তির মেয়াদ আরো এক দফা ৬ মাস বাড়ানো হয়। আর ওই সময় থেকেই ফিরোজায় নিজ বাড়িতে রয়েছেন তিনি।
১৯ মার্চ: মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে বিএনপি। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপির নতুন কমিটি গঠিত হয়। তিন বছর মেয়াদি এই কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এখনও কোনো কাউন্সিলের প্রস্তুতি নেয়নি দলটি। আর দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছয় মাস পরপর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা ডাকার বিধান থাকলেও সেই নিয়মও মানছে না দলটি। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা ২০১৮ সালে ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
এদিকে, জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপির নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার সময় থেকেই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির দুটি পদ ফাঁকা ছিল। পরে গত ১৯ জুন (২০১৯) বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুটি পদ পূরণ করে দলটি। এই দুই পদে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সেলিমা রহমানকে পদোন্নতি দেন তাদের দল বিএনপি। তারা দুজনই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, যুব বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক এবং সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও ফাঁকা রাখা ছিল। পরবর্তীতে এসব পদে কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
এর মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ ও তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে এখন দলের স্থায়ী কমিটির তিনটি পদ শূন্য রয়েছে। এসব পদেও কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ১৬ মার্চ বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক মো. শাহাব উদ্দিন দলের সব পর্যায়ের পদ থেকে পদত্যাগ করার কথা জানিয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তবে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে কি না- সে বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে ওই সময় কিছু জানানো হয়নি।
২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। ওইদিনই সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। এখনো তারেক রহমানই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ভোট, উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে বলে দাবি দলটির। এই লক্ষ্য নিয়ে দলটি নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা করেছে। কিন্তু এসব নির্বাচনে ভোটের দিন নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যায়নি। এমনকি নেতাকর্মীদের ভোট কেন্দ্রেও দেখা যায়নি। আর ভোটের ফলাফল ঘোষণার আগেই প্রতিটি নির্বাচনের ফলাফলকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে দলটি।
এবিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে ও দলীয় সরকারের অধীনে এদেশে কখনোই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। বিশেষ করে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যারা পুরোপুরি সরকারের ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে তাদের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।