মৃত্যু তাকে নিয়েছে। জাতিসংঘ তাকে নেয়নি। জাতিসংঘ মানে এই শতকের পুঁজিবাদী সংগঠনগুলো তাকে নিতে পারেনি। তাকে হয়তো বিক্রি করা গেছে তারকা খ্যাতির কারণে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার যাপনিক আচরণের জন্য তাকে নিতে পারেনি তথাকথিত সভ্যসমাজ। ফলে আমৃত্যু বিভিন্ন কেলেংকারির তথ্যযুদ্ধ দিয়ে তাকে ঘায়েল করা হয়েছে। ১৯৬০ সালে জন্ম নেয়া দিয়াগো ম্যারাডেনার ৬০তম জন্মদিন ছিল গত ৩০ অক্টোবর। কিছুদিন ধরেই শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না তার। সুস্থভাবে বাঁচতে হলে ছাড়তে হবে মদের নেশা, এভাবেই তার পরিবারকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। পরামর্শ মেনে সপ্তাহ দুই আগে পানাসক্তি ছাড়তে নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সারা পৃথিবী কাঁদিয়ে তিনি বুধবার বিকেলে নিজ বাসভবনে মারা যান। শুধুমাত্র একজন বিখ্যাত ফুটবলার নন, ইতিহাসে ম্যারাডোনার নাম থাকবে নানা কারণেই। তার জীবনে নিয়ম গড়েছেন। নিজে নিয়ম ভেঙ্গেছেন। তার মহান দিকটি ছিল রাজনীতি। বুয়েন্স আয়ার্সের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন বলে নয়, তিনি রাজনৈতিক দীক্ষা নিয়েছিলেন কিউবার মহান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কাছ থেকে। আর্জেন্টিনার আরেক বিপ্লবী চে গুয়েভারা রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন: মাঝেমধ্যে আমি চিন্তা করি, আমার পুরো জীবনই যেন এক সিনেমা। সিনেমার রিলে যেন আমার জীবনের সব ছবি ধারণ করে রাখা আছে। সবাই ছোটবেলায় বিখ্যাত কাউকে অনুসরণ করে। আমার ছোটবেলায় আর্জেন্টিনায় সত্যিকারের বিখ্যাত অনুকরণীয় ফুটবলার কেউ ছিল না। ফুটবল ছিল তখন আর্জেন্টিনার গরিব আর বস্তিতে থাকা ছেলেদের মুক্তির একটা বড় উপায়। দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে আমরা ফুটবলকে বেছে নিতাম। বুয়েনস আয়ার্সে আমরা খুব ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকতাম। ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে যেত। আমার বয়স যখন তিন, তখন আমার এক কাজিন আমাকে একটা চামড়ার বল উপহার দেয়। সেটাই ছিল আমার প্রথম বল। আমি সেই বলটিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতাম। তাকে নিয়ে হলিউডের সবচেয়ে রাজনীতিপ্রবণ পরিচালক কস্টারিকা ছবি বানিয়েছেন। সেখানে তার জীবন সংগ্রাম থেকে সমস্ত বর্ণাঢ্য জীবন উঠে এসেছে। জাদু? হ্যাঁ, ফুটবল পায়ে দুজনই জাদুর জন্ম দিয়েছেন তিনি। শুধুমাত্র একটি বিশ্বকাপ জিতে পৃথিবীর ইতিহাসে এতবড় তারকা হওয়া অসম্ভব। তিনি ফুটবল খেলাকে যুদ্ধ হিসেবে নিয়েছিলেন। ১৯৮২ সালে আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ড দ্বীপ যেটি ছিল ব্রিটিশ শাসিত সেটি নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধে প্রায় ৮০০ সেনার প্রাণের বিনিময়ে আর্জেন্টিনা পরাজিত হয়। আর্জেন্টিনার তরুণ প্রজন্মের কাছে সেটা ছিল একটা দগদগে ক্ষত। তারপরই ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ ফুটবল। মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা মানেই তো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে দৌড়। মাঝমাঠ থেকে দৌড়টা শুরু করেছিলেন, থেমেছিলেন বিশ্বের সব ফুটবল অনুরাগীর হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার পরই। বর্ণনাতেও শব্দ সংকটে ভুগতেন সবাই। কারও চোখে তিনি সর্বকালের সেরা ড্রিবলার। কারও কাছে তিনি ফুটবলের সেরা অলরাউন্ডার। প্রতিটি কাজে ছিলেন দক্ষ। কারও কাছে তিনি সেরা প্লেমেকার। দলের খেলা সৃষ্টিতে ছিলেন অনন্য। কারও চোখে বেস্টের মতো পাস দেওয়ার দক্ষতা আর কেউ দেখাতে পারবেন না। তাঁর বিপক্ষে খেলতে নামা মানেই ডিফেন্ডারদের নাচের তালিম নেওয়া।
এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন: আপনি এত জনপ্রিয় তো রাজনীতি করেন না কেন? ম্যারাডোনা উত্তর দিয়েছিলেন: পৃথিবীর অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। তাদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছে। কিন্তু তারা পরে আর কেউ যোগযোগ রাখেনি। কেন? এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন: আমি প্রথম কথাটাই বলি ধনী দরিদ্রের বৈষম্য নিয়ে। একারণে হয়তো কেউ আমার রাজনীতি করা নিয়ে আগ্রহী হয়নি।
বিশ্ব ফুটবলে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের নানা ষড়যন্ত্র ভেদ করে এককভাবে উঠে দাঁড়ানো খেলোয়াড় ম্যারাডোনা। আজ পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অপূরণীয় ক্ষতির নাম দিয়াগো ম্যারাডোনার মহাপ্রস্থান। তার মহা প্রয়াণে আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভালোবাসা।