বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনা সপ্তাহ : জনসচেতনতার গুরুত্ব

5
Spread the love

-মোঃ মাইদুল ইসলাম প্রধান

গ্রামের পাড়ার মোড় বা হাটবাজারেই শুধু নয়, খোদ রাজধানী ঢাকা শহরেই এমন অনেক শিক্ষিত ও সচেতন মানুষজনও এখন অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে কোন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের দ্বারস্ত হতে চান না। ওষুধের ফার্মাসিতে থাকা কোন ওষুধ বিক্রেতার পরামর্শেই ওষুধ কেনার কাজটি সেড়ে ফেলেন এবং ডোজ শেষ না করে মাঝ পথেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করেন। একজন গ্রাম্য দিন মজুর থেকে শুরু করে রাজধানীর উচ্চ শ্রেণির শিক্ষিত মানুষটিও অবলিলায় এই কাজটি করে যাচ্ছেন। শুধু মানুষজনের দেহেই অ্যান্টিবায়োটিকের ইচ্ছেমতো ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপারটি কেবল তাই নয়; সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে এই অযাচিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে খামারে লালন-পালন করা পশু-পাখিদের শারীরেও। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের অনানুমোদিত অ্যান্ট্রিবায়োটিকের ব্যবহারের ফলে ইতোমধ্যেই অনেকগুলো অ্যান্টিবায়োটিক মূলত এখন মানুষের দেহে অকার্যকর হয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞগণ জানিয়েছেন। আগামী দিনগুলিতে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবন না করতে পারলে চিকিৎসা জগতে খারাপ সময়ই অপেক্ষা করছে বলে মনে করা হয়েছে। এ জন্য এখনই সচেতনতা বৃদ্ধি করা গোটা বিশ্বের জন্যই জরুরি কাজ হয়ে দাড়িয়েছে ।

এদিকে, গত ১৮ নভেম্বর থেকে বিশ্বব্যাপি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনা সপ্তাহ শুরু হয়েছে যা ২৪ নভেম্বর শেষ হচ্ছে। এই সপ্তাহ উপলক্ষ্যে বিশ্বের নানা সংগঠন আলোচনা সভা, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা করছে। আমাদের দেশেও এরকম বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের অযাচিত ব্যবহারের ফলে আগামীতে মানুষের চিকিৎসা ক্ষেত্রে কতটা বিপর্যয় নেমে আসতে পারে তা সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলাটা সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিভাগ যেমন সিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, পশু সম্পদ অধিদপ্তর সারাদেশব্যাপী এ সপ্তাহ উদযাপন করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং দেশিয় সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে, বিভাগীয় পর্যায়ে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একযোগে সপ্তাহটি পালন করা হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা নিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ হয়ে আসছে, যা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

এ বছর এ সপ্তাহের শুরুটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য কেবলই আনন্দের। কেননা, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আরেকবার নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়েছে এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিস্ট্যিান্স সংবরণকে সামনে রেখে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২ বছরের জন্য ডঐঙ, ঋঅঙ ও ঙওঊ কর্তৃক ঙহব ঐবধষঃয এষড়নধষ খবধফবৎং এৎড়ঁঢ় ড়হ অহঃরসরপৎড়নরধষ জবংরংঃধহপব এর কো-চেয়ার হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। শুধু নিজের দেশে নয়, সারা বিশ্বের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিস্ট্যান্স সংবরণে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে এই গ্রুপ। ইতোমধ্যেই গোটা দেশবাসীসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব জাহিদ মালেক এমপি, মন্ত্রণালয়ের সচিবদ্বয়সহ সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এই বিরল অর্জনের জন্য শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানিয়েছেন।

সারা বিশ্ব জুড়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং জীবাণুসমূহ অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেই চলেছে। জীবাণুসমূহ বহু প্রকার অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে কম বা বেশি দামি সকল প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক সংক্রমন চিকিৎসায় অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ ধরনের রোগ জীবাণু ব্যক্তির

জন্য প্রাণঘাতী হওয়া ছাড়াও সমাজে ব্যাপক প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করতে পারে। উল্লেখ্য, ডড়ৎষফ ঐবধষঃয অংংবসনষু, ২০১৫-অহঃরসরপৎড়নরধষ জবংরংঃধহপব চৎবঢ়ধৎবফহবংং, ঝঁৎাবরষষধহপব ্ জবংঢ়ড়হংব” অমবহফধ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছে। তা ছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী জনসচেতনা বৃদ্ধিসহ পলিসি ও নির্দেশিকা প্রণয়নপূর্বক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের উপর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে ইতোমধ্যেই কৌশলপত্র, কর্মপরিকল্পনা, ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন ইত্যাদি প্রণয়ন করেছে। ইতোমধ্যেই জাতীয় কর্মকৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে যেখানে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারের উদ্যোগসমূহ ঠিক করা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি সারভেইল্যান্স চলমান রয়েছে এবং সারভেইল্যান্সটিকে আরো বেগবান করবার জন্য কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে রেফারেন্স ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সমন্বিতভাবে ঔষধ প্রশাসন, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য অধিদপ্তর এবং অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতের প্রচেষ্টা চলমান। সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য ওচঈ গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ৬ মাসের মধ্যেই প্রায় ৬০০০ চিকিৎসক নার্সদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং সকল হাসপাতালে আইপিসি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

অ্যান্টিমাইকোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সহনীয় মাত্রায় আনয়নের জন্য চিকিৎসকসহ সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা অতীব প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন এডভোকেসি সভার আয়োজন করা হয়েছে। কেননা, অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স প্রতিরোধে আমাদের সকলেরই ভূমিকা রয়েছে। প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে চিকিৎসক যেমন ভূমিকা রাখতে পারেন তেমনি যারা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন তারাও ভূমিকা রাখতে পারেন। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ক্ষতির কারণ। শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসক-এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় ও সেবনের মাধ্যমে রেসিস্টেন্সের হার অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সরাসরি ঔষধের দোকানে হাতুড়ে ও অন্য কোন রোগীর, প্রেসক্রিপশন মেতাবেক অ্যান্টিবায়োটিক ক্রয় বা সেবন একেবারেই কাম্য নয়। যথোপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারই আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের রেসিস্টেন্স জীবাণুদের মরণঘাতী সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

শেষ কথায় এটিই বলা যায় যে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ব্যবহারে কেবল মেডিকেল পেশায় নিয়োজিত মানুষজনদেরই সচেতন হতে হবে তা নয়; বরং সাধারণ মানুষের মনে উপলব্ধির জায়গাটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে উন্নতি করে নিয়ে যৌক্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের নাগরিক সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করতে শুধু অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। সাধারণ মানুষজনদেরকেও সচেতন করতে হবে। আর সব মানুষের সচেতনতার জন্য ব্যাপক প্রচারণার বিকল্প নেই।- পিআইডি ফিচার