৩ দিনের রিমান্ডে ইরফান ও সহযোগী জাহিদ

2
Spread the love

ঢাকা অফিস

ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের মেজ ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বরখাস্ত হওয়া কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিম ও তার সহযোগী জাহিদকে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের মামলায় তিনদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। বুধবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এ আদেশ দেন।

এর আগে মঙ্গলবার (২৭ অক্টোবর) নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর ও হত্যার হুমকির ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের গ্রেপ্তার দেখানো-পূর্বক সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (নিরস্ত্র) আশফাক রাজীব হায়দার। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নুর এ বিষয় শুনানির জন্য বুধবার দিন ধার্য করেন। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগে মেজ ছেলে ও দেহরক্ষীর বিরুদ্ধে মামলার পর ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী মোহাম্মদ সেলিমের পুরান ঢাকার দেবীদাস ঘাটের বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব। সোমবার দুপুরে ওই বাড়ি ও তার ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিমের কার্যালয়ে চালানো অভিযানে অবৈধ অস্ত্র, ইয়াবা, ওয়াকিটকিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানায় র‌্যাব। অবৈধভাবে রাখা বিপুল সংখ্যক ওয়াকিটকি ও বিদেশি মদ পাওয়া যাওয়ায় ইরফান ও তার দেহরক্ষী জাহিদকে এক বছরের কারাদ- দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার ভোরে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান, গাড়িচালক, দেহরক্ষীসহ অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও সরকারি কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগে রাজধানীর ধানম-ি থানায় মামলা করেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খান। এজাহারের বরাত দিয়ে ধানম-ি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুন্নাহার জানান, মামলায় চারজনকে এজাহারনামীয় এবং অজ্ঞাত আরও দু-তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। ওই চার আসামি হলেন মোহাম্মদ ইরফান সেলিম, দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদ, হাজী সেলিম ও মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু এবং গাড়িচালক মিজানুর রহমান। তাদের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে পথরোধ করে সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর, জখম ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ইরফান নোয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরীর জামাতা। ধানম-ি থানা পুলিশের বিবরণ ও মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে (ল্যাবএইড হাসপাতালের কাছে) ‘জাতীয় সংসদের’ স্টিকার লাগানো একটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। ওয়াসিফ মোটরসাইকেল থামিয়ে গাড়িটির গ্লাসে নক করে নিজের পরিচয় দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার কারণ জানতে চান। তখন এক ব্যক্তি গাড়ি থেকে বের হয়ে তাকে অকথ্য গালিগালাজ করে। এরপর গাড়িটি কলাবাগানের দিকে চলে যেতে থাকে। মোটরসাইকেল নিয়ে ওয়াসিফও তাদের পেছনে পেছনে যান। এরপর কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে থামার পর মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ান ওয়াসিফ। তখন তিন-চারজন লোক গাড়ি থেকে নেমে বলতে থাকে, ‘তোর বাহিনী বাইর করতেছি, তোর লেফটেন্যান্ট/ক্যাপ্টেন বাইর করতেছি। তোকে আজ মেরেই ফেলব’ এ কথা বলে তাকে কিলঘুষি মারতে থাকে। পরে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা এসে তাকে উদ্ধার করেন। পুলিশ আসায় হামলাকারীরা গাড়িটি রেখে পালিয়ে যায়। ধানম-ি থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গাড়ি ও মোটরসাইকেলটি থানায় নিয়ে যায়। মারধরের ঘটনাটি পথচারীরা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে মুহূর্তেই ভাইরাল হয়।

সোমবার দুপুরে হাজী সেলিমের চকবাজার থানা এলাকার দেবীদাস ঘাটের বাড়ি ঘিরে ফেলেন র‌্যাব সদস্যরা। এরপর ইরফান, জাহিদ ও গাড়িচালক মিজানকে হেফাজতে নেওয়া হয়। পরে মিজানকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে র‌্যাব। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, দুপুর ১টার দিকে পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের ২৬ দেবীদাস ঘাটের বাসায় অভিযান শুরু করেন তারা। র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে একটি গোয়েন্দা দল, র‌্যাব-৩ ও ১০-এর সদস্যরা এতে অংশ নেন। ওই বাড়ির চতুর্থ ও পঞ্চম তলাটি ডুপ্লেক্স পদ্ধতিতে নির্মাণ করা। চতুর্থ তলার উত্তর কর্নারের রুমটিতে থাকেন ইরফান সেলিম। পুরো বাসায় ছড়ানো-ছিটানো দেখা যায় নানান অবৈধ জিনিসপত্র। বাড়িটি হাজী সেলিমের বাবা অর্থাৎ কাউন্সিলর ইরফানের দাদা চাঁন সরদারের।

অভিযান শেষে সন্ধ্যায় এক ব্রিফিংয়ে আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য ও আলামতের ভিত্তিতে আমরা অভিযান চালিয়েছি। আমরা ইরফানের বাসা থেকে অনুমোদনহীন ৩৮টি ওয়াকিটকি, ৫টি ভিপিএস সেট, একটি অবৈধ বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, একটি পিস্তল, একটি একনলা বন্দুক, একটি ব্রিফকেস, একটি হ্যান্ডকাফ, একটি ড্রোন, সাত বোতল বিদেশি মদ ও কিছু বিয়ার উদ্ধার করেছি। এ ছাড়া দেহরক্ষীর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪০০ পিস ইয়াবা।’

তিনি আরো বলেন, ‘ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের পাশে ইরফানের একটি টর্চার সেল ছিল। সেখান থেকে হ্যান্ডকাফ উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে তিনি বিভিন্নজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করতেন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে নিয়মিত মামলা করব।’

আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মোহাম্মদ ইরফান সেলিম জানিয়েছেন, এসব ওয়াকিটকির মাধ্যমে তিনি তার বাসার আশপাশের ১২ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা নেতাকর্মী ও অনুসারীদের সঙ্গে কথাবার্তা এবং যোগাযোগ রাখতেন। উদ্ধার ভিপিএস সেটগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শনাক্ত বা পর্যবেক্ষণ করতে পারত না। তার বাসার চার ও পাঁচতলার কন্ট্রোল রুম থেকে এসব উদ্ধার করা হয়; যা আইনত অবৈধ। এসব ওয়াকিটকি দিয়ে ইরফান মূলত চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানান তিনি।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘উদ্ধার অস্ত্র ও হ্যা-কাফের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ইরফান সেলিম। আমাদের ধারণা, এগুলো দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখাতেন। তার অস্ত্র দুটির কোনো লাইসেন্স নেই। ইরফানের রুমের তোশকের নিচে ম্যাগাজিন ভর্তি বিদেশি পিস্তলটি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পঞ্চম তলায় পূর্ব পাশের কর্নারে ৫টি ওয়ারলেস ভিপিএস সিস্টেম ও ৩৮টি ওয়াকিটকি সেট, একটি হ্যান্ডকাফ, একটি বন্দুক, বিদেশি মদের বোতল ও বিয়ার পাওয়া গেছে। ইরফান ও জাহিদকে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে ছয় মাস ও নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য রাখার দায়ে ছয় মাস করে মোট এক বছর কারাদ- দেওয়া হয়েছে।’

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, ‘অভিযানের আগেই আমাদের টিমের সদস্যরা হাজী সেলিমের ছেলেকে হেফাজতে নেন। ইরফান সেলিম নিজেও একজন জনপ্রতিনিধি। আমরা থানা পুলিশের মাধ্যমে তাকে আদালতের কাছে সোপর্দ করব।’