অভাব বাড়লেও কমেনি ভালোবাসা

80
Spread the love

সাবজাল হোসেন, বিশেষ প্রতিনিধি

গতকাল দুপুরে খেয়েছিলাম আর রাতে না খাওয়া। সকালে কেউ দিলে জুটবে না হলে উপোষ। এভাবে চলে সারাবছর। এক সময়ে স্বামী আব্দুর রহমান শেখের থাকার জায়গা ছিল স্টেশনে। আর আমার গতি হয়েছিল এক ভিখারীর ঘরে। রহমানের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য থাকলেও অসহায়ের দিক দিয়ে ছিলাম একই রকম। তাই দু’জনের কল্যানে এলাকার লোকজন আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তার সাথে সংসার জীবনে কাটিয়েছি ২২ টি বছর। বয়সের ভারে ১০ বছর ধরে স্বামী কর্মক্ষমতা হারিয়ে এখন আর একা চলাফেরা করতে পারেন না। আমিও রোগাক্রান্ত। এখন প্রতি সাজের খাবারের জন্য প্রতিবেশী ও অপরের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। এমন অবস্থায় দিন চলে। তারপরও অসহায় বৃদ্ধ স্বামীকে ফেলে যেতে পারি না। স্বামীর প্রতি এমন অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা বললেন স্ত্রী চায়না বেগম। তারা ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ঝ্্ুঁপড়ি ঘরে বসবাস করছেন।

সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, মোবারকগঞ্জ স্টেশনের পাশেই রেলওয়ের জায়গায় মাটির ওপরে টিন দিয়ে ঘেরা, টিনের ছাউনির একটি ঝুপড়ি ঘরে তাদের বসবাস। যেখানে স্যাঁতসেতে মাটির ওপরই বসা আছে বয়োবৃদ্ধ আব্দুর রহমান ও চায়না বেগম। বয়সের ভারে অস্থিচর্মিসার হওয়া আব্দুর রহমান কানে খাটো,এখন ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না। চায়না বেগমও রোগাক্রান্ত দেহে স্বামীকে সেবা করে যাচ্ছেন।

চায়না বেগম জানান, মা বাবার মৃত্যুর পর আমি অসহায় হয়ে পড়ি। আমার বয়স যখন ১৫ বছর তখন বাধ্য হয়ে কালীগঞ্জ আড়পাড়ার শিবনাথ মাষ্টারের বাসায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতাম। কিন্ত মাথা গোজার মত কোন স্থান ছিলনা। তখন ভানু নামের এক ভিকারী তার কুড়ে ঘরে আমার থাকার সুযোগ দেয়। আর ঠিকানা বিহীন আশ্রয়হীন আব্দুর রহমান দীর্ঘদিন কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় দিনমজুরের কাজ করতো। আর আশ্রয় না থাকায় রাতে স্টেশনে শুয়ে থাকতো। অসহায়ত্বের দিক দিয়ে রহমান আর আমার জীবনের সাথে অনেকটা মিল ছিল। তাই এলাকার মানুষ আমাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। এরপর থেকে বাসা ভাড়ায় থাকতাম। আমাদের কোন সন্তান নেই। বয়সের ভারে প্রায় ১০ বছর আগেই স্বামী রহমান কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। আমি পরের বাসায় কাজ করে দ’ুজনের পেট চালাতাম। কিন্ত আমি নিজেও শারীরিকভাবে চরম অসুস্থ। এখন আর পরের বাসায় কাজে ডাকে না। আবার শারীরিকভাবে অচল রহমানেরও দেখার মত কেউ নেই। তাই চেয়ে চিন্তে চলতে হয়। প্রতি সাজের খাবারের কথা প্রতি সাজেই ভাবতে হয়। কেউ উদারতার হাত না বাড়ালে ক্ষুধাপেটেই থাকতে হয়। বৃদ্ধ বয়সে আমরা উভয়ই আগের অসহায় অবস্থার চেয়ে খারাপ আছি। এমন অবস্থায় বেঁচে আছি আমরা দুটি প্রাণী। কিন্ত আমাদের ভাগ্যে জোটেনি কোন সরকারী সুযোগ সুবিধা।

প্রতিবেশী জাহিদুল ইসলাম জানান, স্টেশন এলাকায় অনেকে ঝুপড়ি ঘর বেধে মাথা গুজে আছেন। তাদের মধ্যে রহমান ও চায়না সবচেয়ে বেশি অসহায়। এ মহল্লার বেশির ভাগ মানুষই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। অনেকেই আছেন মানুষের কাছে হাত পেতে বেঁচে আছেন। কিন্ত চায়না -রহমানের মত অসহায় আর কেউ নেই। চায়না রহমানের কষ্ট দেখে তারাও অনেকে নিজেদের খাবার দিয়ে ভাগাভাগি করে খান। তাদের বিষয়টি এমন সকালে খাবার জুটলেও দুপুরের নিশ্চয়তা নেই। আবার দুপুরে থাকলেও হয়তোবা রাতে থাকতে হবে খালি পেটে। এমন মানবেতর জীবন যাপন করলেও রহমান চায়নার ভাগ্যে জোটেনি কোন প্রকার সরকারী সহযোগীতা। বিষয়টি দুঃখজনক।

প্রতিবেশী শাহানাজ বেগম জানান, ছোটবেলা থেকে এ এলাকায় দেখছি দিনমজুরের কাজ করতে। শুনেছি আজ থেকে ৩০/৩৫ বছর আগে তিনি এ এলাকায় এসে মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন আর ছিন্নমুলদের সাথে স্টেশনে শুয়ে থাকতেন। দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকায় থাকলেও তার আসল ঠিকানা কেউ জানেন না। তার মত চায়নাও ছিলেন আরেক অসহায়। এলাকার মানুষ তাদের মঙ্গলের জন্য বিয়ে দিয়ে দেন। বৃদ্ধ বয়সে এসে তারা চরম খাবারের কষ্টে থাকেন। প্রতিবেশীদের অনেকেই চরম হতদরিদ্র তারপরও চায়না রহমানের খাবারের কষ্ট দেখে তারা নিজেদের খাবার দিয়ে থাকেন। চায়না বেগম নিজেও অসুস্থ। তারপরও স্বামী বৃদ্ধ রহমানকে যেভাবে সেবাযতœ করে যাচ্ছেন সে জন্য চায়নাকে ধন্যবাদ দিতে হয়।

কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কৌশিক খান জানান, আব্দুর রহমান ও চায়না বেগম চরম অসহায় জীবন যাপন করেন এটা তিনি শুনেছেন। তারা কোন সরকারী ভাতার আওতায় না থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবেন।

কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ জানান, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ভাতা জন্য তালিকা সংগ্রহ করে থাকেন। তারপরও অনেকে বাদ পড়ে যান। পরবর্তীতে তাদেরকে আবার তালিকাভুক্ত করা হয়। তিনিও শুনেছেন বয়োবৃদ্ধ আব্দুর রহমান চায়না বেগম দম্পতি খুব কষ্টে আছেন। খোঁজ নিয়ে তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হবে।