ফারাজী চাচা স্মরণে

23
Spread the love

-সন্তোষ দাস

আজ (২০ অক্টোবর) শ্রদ্ধেয় ফারাজী শাহাদাৎ হোসেন চাচার বারোতম মৃত্যুবার্ষিকী। অ্যাডভোকেট ফারাজী শাহাদাৎ হোসেন যশোরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে অতিপরিচিত এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় একটি নাম। শুধু যশোর বললে কম বলা হবে, জাতীয় পর্যায়েও বটে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই প্রথিতযশা মানুষটি দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৮ সালের ২০ অক্টোবর আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নেন। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

একজন মানুষ যে একাধিক ক্ষেত্রে সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেন, তা এই মানুষটিকে না দেখলে জানা যেত না। তিনি যশোরের শহীদ মশিউর রহমান আইন মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে অধ্যক্ষ হিসেবেও। তিনি ছয় বার যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের তিনি ছিলেন দীর্ঘদিনের সিনিয়র সহসভাপতি, আহ্বায়ক এবং ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। দলে তার সফল নেতৃত্ব সর্বজনবিদিত। বড় দলে গ্রুপিং-লবিং, নেতৃত্বের কোন্দল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আমরা জানি তিনি যতদিন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন ততদিন কোনো গ্রুপিং আমাদের চোখে পড়েনি। তার নেতৃত্বের প্রতি কথিত সব গ্রুপেরই ছিল প্রশ্নাতিত আনুগত্য। আর এটা সম্ভব হয়েছিল ব্যক্তি হিসেবে সর্বমহলে তার অপরিসীম গ্রহণযোগ্যতার কারণে। তিনি ছিলেন সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আস্থাভাজন এবং ভরসার স্থল। এ কারণে যশোর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা তার উপর নেতৃত্ব অর্পণ করেছিলেন এবং সেখানে তিনি শতভাগ সফল ছিলেন। বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কালিমা তাকে এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি। সৎ এবং নির্লোভ এই মানুষটি রাজনীতি করেছেন দেশ এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে, অর্থবিত্ত বা ক্ষমতার মোহে নয়। জেলা পর্যায়ে দলের শীর্ষ অবস্থানে থেকেও ব্যক্তিস্বার্থে দলীয় প্রভাবকে কখনও কাজে লাগাননি।

তিনি যশোরের অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে ফারাজী চাচার সাথে আমি প্রথম পরিচিত হই ১৯৮৬ সালে। ঐ বছর যশোর এম এম কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার সুবাদে চাচার সাথে পরিচয় ঘটে। কিন্ত তার ঘনিষ্ঠ ¯েœহের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় আরও পরে। অর্থাৎ ঐ বছরের শেষের দিকে যখন তারই সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ সন্তান যশোর চাঁদের হাটের (জাতীয় শিশু কিশোর ও যুব কল্যাণ সংগঠন) প্রতিষ্ঠাতা ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল, আমাদের অতি আপনার বুলবুল ভাইয়ের হাত ধরে চাঁদের হাট করতে যাই। এই সময়ে তার সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য আমার হয়। যশোর চাঁদের হাটের বর্তমান কার্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে সুদীর্ঘ এক দশক (১৯৮২-১৯৯২) ফারাজী চাচা তার লোন অফিস পাড়ার নিজ বাসভবনে যশোর চাঁদের হাটকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি নিজেও ছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় এই সংগঠনের উপদেষ্টা। তিনি যে কতটা উদার ছিলেন তার একটি প্রমাণ এই যে, তিনি তার নিজ বাসভবনে একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আমরা তখনকার কিশোর-যুবকরা যে খুব শান্ত ছিলাম, তা তো নয়। সংগঠন করতে গিয়ে আমরা শিশু-কিশোর যুবকরা হৈ চৈ হুটোপুটি করেছি। তিনি পিতৃ¯েœহে আমাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং সংগঠনকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছেন। কারও নিজ বাড়িতে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নিয়মিত কার্যক্রম, অনুষ্ঠানাদি করতে দেওয়ার মতো মানসিকতার মানুষ আমাদের সমাজে বিরল। চাচা ছিলেন সেই বিরলদের মধ্যে একজন।

তাঁর উদারতার আর একটি প্রমাণ পাই ১৯৯৬ সালে যশোর ল’ কলেজে পড়তে গিয়ে। তখন তিনি সেখানকার উপাধ্যক্ষ। জানতে পারি, যেকোনো শিক্ষার্থী তাঁর কাছে আবেদন করলে তিনি দল-মত নির্বিশেষে সেই শিক্ষার্থীর ভর্তি ফি, বেতন ও পরীক্ষার ফি কমিয়ে দেন। ক্ষেত্র বিশেষে মওকুফ করে দেন। বলতে দ্বিধা নেই আমি নিজেও এই সুযোগ গ্রহণ করেছি। এছাড়া যেহেতু তিনি একজন প্রতিথযশা আইনজীবী ছিলেন, তাই দলীয় লোকজনতো বটেই, অভাবী লোকজনদেরও তিনি বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা দিয়েছেন।

বহু গুণে গুণান্বিত আপদমস্তক এই ভালো মানুষটি অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বয়স হয়েছিল সত্তর বছর। এটা অবশ্যই যাওয়ার সময় নয়। বেঁচে থাকলে হয়ত আমরা তাঁকে পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর চার আসন (অভয়নগর-বাঘারপাড়া) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখতাম। কারণ এই আসনে তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম শক্তিশালী মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন এবং দীর্ঘদিন গণসংযোগ করে যাচ্ছিলেন। তাছাড়া ঐ সময়টিতে তাঁর উপর নেত্রীর আস্থা ছিল।

তাঁর মৃত্যুতে যশোর তথা দক্ষিণবঙ্গের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ক্ষতি হয়েছিল তা এখনও পূরণ হয়নি। এখনও আমরা যশোরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চাচার অভাব বোধ করি। যশোরের মানুষ এখনও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তাঁর বারোতম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম এবং তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক : প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট, ০১৯১৮২২৪৯০৫,