ফাঁসি ছাড়াও যা দরকার

1
Spread the love

উদিসা ইসলাম

‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইনে সংশোধনী আনা হচ্ছে’, এ খবর প্রকাশের পর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত দেখা গেছে। আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলে আর বিচারে তা নিশ্চিত করা গেলে, ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা কমে আসবে। নারী অধিকার নেত্রীরা বলছেন, যখন কিনা নারী নির্যাতনের ঘটনায় শাস্তি নিশ্চিত হতে দেখা যায় না, যে শাস্তি আইনে আছে তারই প্রয়োগ দেখতে পাই না, তখন আইন সংশোধন করে সাজা বাড়িয়ে ধর্ষণ কমবে—সেই আশা করা যায় না। তারা বলছেন, নিরপেক্ষ সংবেদনশীল তদন্ত, ভিকটিম ও সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে কোনও উদ্যোগ কাজে আসবে না।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত ৯ মাসে গড়ে প্রতিদিন তিন জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ অক্টোবর নোয়াখালীতে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। প্রায় এক মাস পর প্রকাশ হওয়া এই ভিডিও’র ঘটনায় পুরো দেশ প্রতিবাদে নামে। এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকায় স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে নিয়ে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে।

একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার বিচারের দাবিতে রাজপথ ফাঁসি চাই স্লোগানে যখন মুখরিত, সেই মুহূর্তে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, বর্তমান নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বদলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে যাচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা পাওয়ার পর এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। আনিসুল হক বলেন, ‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনের একটি প্রস্তাব আগামী মন্ত্রিসভা বৈঠকে যাচ্ছে।’

নতুন আইন করলেই যে ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন বন্ধ হবে তা নয়— উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেন, ‘আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে না হলে কোনও সংশোধন কাজে আসবে না। দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রের উদাসীনতার জন্য নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। কেননা, অপরাধীরা মনে করে, তারা শাস্তি পাবে না।’ মামলার তদন্তে কালক্ষেপণ বন্ধ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ভিকটিম এবং সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং লক্ষ রাখতে হবে, কত দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা যায়।’

ধর্ষণের মামলা কোনোভাবেই যেন আপস মীমাংসা না হয়, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে উল্লেখ করে ঢাকা মহানগরের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবু আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপস করলে বাদীর শাস্তি হবে—এই বিধান রাখতে হবে এবং সেটি সবাইকে জানাতে হবে।’ ধর্ষণ রাষ্ট্র, সমাজ ও দেশের বিরুদ্ধে অপরাধ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পক্ষে আমি। কিন্তু পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তা না-হলে ধর্ষণ কমবে না। বাদী-আসামি মিলে গিয়ে উল্টাপাল্টা সাক্ষ্য দিয়ে খালাস হয়, আবার কখনও কখনও ভয়ে সাক্ষ্য দেয় না সাক্ষী। ফলে সাক্ষীরও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’

সরকার জনমতকে গুরুত্ব দিয়ে আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ড করতে যাচ্ছে, সেটিকে সাধুবাদ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অপরাধ কমবে না। কেবল ভীতি দেখানোর জন্য যদি শক্ত আইন আনা হয় এবং তার বাস্তবায়ন সম্ভব না হয়, তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে না। ধর্ষণের অপরাধে কতজন অপরাধীকে আজ পর্যন্ত যাবজ্জীবন দেওয়া গেছে? ফলে আইন কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে, সেটিতে মনোযোগী হতে হবে। পুলিশ, প্রসিকিউশন, বিচারব্যবস্থা, কারাগার নিয়ে নতুন করে না ভেবে আইন সংশোধনে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না।’

তবে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলে এবং এক-দুইজন অপরাধীকে সেই শাস্তি দিলে অপরাধ অবশ্যই কমবে বলে মনে করেন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই খুশি যে, সরকার এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিয়েছে।’ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যেসব দেশে কঠিন সাজার ব্যবস্থা আছে, সেসব দেশে অপরাধ তুলনামূলক কম। শাস্তির উদ্দেশ্যই হলো প্রতিহিংসা নয়, অপরাধীসহ অন্যদের সতর্ক করা। তবে কেন আমাদের দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধের শাস্তি ৪ থেকে ৫ শতাংশও নিশ্চিত করা যায় না, সেটি নিয়েও ভাবার আছে।’ কারণগুলো খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিয়ে সাজা হওয়ার হার অন্তত ৫০ ভাগে নিয়ে আসতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।- বাংলা ট্রিবিউন