মোঃ শামীম হোসেন, বাজুয়া প্রতিনিধি
পুরুষেরা মাছ ধরা, গাছকাটে, গোলপাতা কাটে, কাঁকড়া ধরে আর মধু আহরন করে থাকে আর নারীরা ব্যস্ত থাকেন চিংড়ির পোনা ধরার কাজে। আবার নারীরা কখনো পুরুষের নৌকায় সুন্দরবনে যান মাছ ধরতে।
শিশুরা হাঁটাচলা শিখে বাইরে বের হওয়ার পর থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে বনের কাজে। এত কষ্টের পরেও সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলোর বনজীবীদের কষ্টের দিন শেষ হয় না। পরিবারের সবাই মিলে কঠিন সংগ্রাম করেও তিনবেলা ভাত জোটাতে না পেরে বনজীবীদের অনেকে আবার ফিরছে অন্য কাজে। কেউ এলাকায়, আবার কেউ দূরের শহরে।
কয়রা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে পাথরখালী গ্রাম। কাঁচা পাকা রাস্তা দিয়ে এই গ্রামে ঢুকতেই নারী-পুরুষের ভিড় জমে যায়। সবার মুখেই বনজীবীদের বেঁচে থাকার কষ্টের কথা। সরকারি নানামুখী নিষেধাজ্ঞা আর প্রাকৃতিক নানা কারণে বন এখন আর তাদের জীবিকার পথ দেখাতে পারছে না। এ সব গ্রামের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বাপ-দাদার আমল থেকে থেকে বনের কাজে জীবিকা নির্বাহ করে এসেছে, তাদের অধিকাংশই বছরের বেশির ভাগ সময় কর্মহীন থাকে।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা কয়রা। ওপারে সুন্দরবন, এপারে লোকালয়, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কম প্রশাস্তের ছোট্ট নদী শাকবাড়িয়া। এ নদীর পারে সুন্দরবন লাগোয়া গ্রাম মঠবাড়ি, কাশিয়াবাদ, ৪নং কয়রা, ৫নং কয়রা, ৬নং কয়রা, পাথরখালী, কাটকাটা, গাববুনিয়া, শাকবাড়িয়া, হরিহরপুর, গাতিঘেরি, বীনাপানি, জোড়শিং, আংটিহারা, গোলখালী, পাথরখালী, তেতুলতলার চর,বানিয়াখালী। এ সকল গ্রামগুলো ঘুরে বনজীবীদের জীবন সংগ্রামের নানা তথ্য মেলে। গ্রামগুলোতে দেখা গেছে বহু কর্মহীন মানুষকে গাছের ছায়ায়, দোকানে, রাস্তার ধারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে ।
বনের কাজ ছেড়ে এখন অনেকে মাটিকাটা, কৃষি কাজ,ইটের ভাটায় শ্রম দেওয়া, নদীভাঙন রোধে বলাক বানানো, বালুর বস্তা নদীতে ফেলাসহ নানা কাজ করছে। তবে এতে মজুরি একেবারেই কম। গত বুধবার ভরদুপুরে পাথরখালী থেকে জোড়শিং দিকে যাওয়ার সময় পথে দেখা মিজানুর গাজীর সঙ্গে। পাশের কোনো এক কৃষকের বাড়িতে চুক্তিভিত্তিক একবেলা কাজ শেষে কাঁধে কোদাল নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। মিজানুর আর আমিরুল জানালেন, কখনো কারো বাড়িতে, কখনো চিংড়িঘেরে আবার কখনো বনের কাজে যান।
কিন্তু এ দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল। আবার কাজেও নেই কোনো নিশ্চয়তা। অতিকষ্টে কাজ জোগাড় করতে পারলেও মজুরি খুবই সামান্য। সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করেও দেড়-দুই শ টাকার বেশি পায় না তারা। এলাকার অধিকাংশ মানুষ জানালেন, এক শ্রেনীর চোরা কারবারিরা দিনের বেলায় কাঠ কেটে বন ধ্বংস করছে। অথচ বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের নিরীহ মানুষদের সেখানে যেতে নানা সমস্যা।
বনে বনদস্যুদের আতঙ্ক, বাঘের ভয়। রয়েছে কুমির কামট আর বন বিভাগের লোকের ভয়। কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল বাহারাম বলেন, পারমিটধারী বনজীবীরা কোনো বাধা ছাড়াই বনে কাজ করতে পারে। তবে তাদের আর আগের মতো সুন্দর বনে যাওয়ার আগ্রহ নেই বলে তিনি জানায়। জেলে বাওয়ালীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে সুন্দরবনের গা ঘেঁষে জেগে থাকা এই গ্রামগুলোর মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে বনের ওপর।
বনজীবীদের এইসব গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না। যে বয়সে ওদের স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই শিশুকাল থেকেই ওরা শুরু করে বনে যাওয়ার প্রশিক্ষন। কারণ, ওদের বাবা-মা, দাদা সবাই যে বনজীবী। এই পেশাই হয়তো হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওদের আগামী দিনগুলো। তাই আধুনিক যুগে এ জনপদের সাধারন মানুষ একটু বিকল্প কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা পেলে তাতে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকত পারতো এমন প্রত্যাশা সকলের।