বিশ্ব প্রবীণ দিবসের ভাবনা

13
Spread the love

—হোসনে আরা আক্তার

বার্ধক্য মানুষের জীবন চক্রের একটি অপরিহার্য অংশ। আর্থসামাজিক উন্নয়নের ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো  বাংলাদেশেও মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। একই সাথে ছোট পরিবার গড়ে তোলার কারণে কমছে স্বল্পবয়সি যুবক-যুবতির সংখ্যা। ফলে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যাতাত্বিক পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশেও একইভাবে ঘটছে জনসংখ্যাতাত্বিক পরিবর্তন। নীতি-নির্ধারকদের গবেষণা রিপোর্টে এই শতাব্দীর শেষ প্রান্তে জনসংখ্যাতাত্বিক পিরামিড কাঠামোতে দেখা দেবে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন। জাপানে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বয়োজ্যেষ্ঠ। এই পরিবর্তনের ঢেউ বিশ্বব্যাপী, যার ফলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক নীতিনির্ধারণে এবিষয়টি বিশেষ তাৎপয্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বয়োবৃদ্ধির এই ধারায় দেশে প্রবীণবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। গড়ে তুলতে হবে প্রবীণদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র, নিশ্চিত করতে হবে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা ব্যবস্থা। সর্বোপরি প্রবীণদের সেবায় গড়ে তুলতে হবে প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী এবং বৃদ্ধ নিবাস।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে দেশে মোট জনসংখ্যার ৮% বয়োজেষ্ঠ্য, যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ। বর্তমান গড় আয়ু ৭১ বছর। সাম্প্রতিক গবেষণা রিপোর্টে ২০৫০ সালে দেশে বয়োজেষ্ঠের  সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লক্ষ্যে পৌঁছাবে, যা মোট জনসংখ্যার ২৫.৯০% হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বয়োজেষ্ঠ্য বলতে ৬০ উর্দ্ধ জনসংখ্যাকে ধরা হয়েছে। সে হিসেবে  বাংলাদেশে প্রবীণদের কল্যাণে তেমন কোন সুব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। প্রবীণদের কল্যাণে যে সমস্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন যেমন, বৃদ্ধদের জন্য প্রথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, বৃদ্ধ নিবাস, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ব্যবস্থা, আর্থিক সমর্থন, পুষ্টিকর খাদ্য, ইত্যাদি সরবরাহের  ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল । অধিকন্তু এ দেশের প্রবীন জনগোষ্ঠী ৬০ ঊর্ধ্ব বয়স থেকে কর্মহীনতা, আর্থিক প্রবঞ্চনা, পুষ্টিহীনতা, নিরাপদ পানি ও বর্জ্য ব্যব্যস্থাপনা, পারিবারিক অবহেলা, নিঃসঙ্গতাসহ নানা জটিল অবস্থার ভিতর দিয়ে দিনযাপন করে। শহরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মাঝে এই অবস্থা তেমন একটা পরিলক্ষিত না হলেও নিম্নবিত্ত ও গরিব জনগোষ্ঠীর মাঝে বঞ্চনার এই মাত্রা লক্ষ্যণীয় পর্যায়ে দৃশ্যমান। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের জনগণ পারিবারিকভাবে প্রবীণদের প্রতি যতœশীল ও শ্রদ্ধাশীল হলেও আর্থসামাজিক পরিবর্তনের কারণে  দিন দিন এই  অবস্থার অবক্ষয় হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা, চাকুরি, ছোটো পরিবার, অভিবাসন ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব ইত্যাদির কারণে পারিবারিক এই ঐতিহ্য ক্রমশ্য: বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠী অনেকটা অবহেলা ও নি:সঙ্গতায় জীবন অতিবাহিত করছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী গ্রামের দরিদ্র অধিবাসী হওয়ায় প্রবীণ বয়সে সেবা যতেœর সুবিধা পাওয়ার বঞ্চনা আরো প্রকট। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধীর গতি এবং এর সুফল জনগণের দোড়গোড়ায় সঠিকভাবে না পৌঁছানোর কারণে এই প্রবঞ্চনার আরো একটি কারণ। গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থসেবা এমনিতেই নাজুক, তার ওপর প্রবীণদের জন্য আলাদা কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। দেশে বিরজমান বেকারত্বের কারনে অনেক যুবক-যুবতীদের কর্মহীন হতে দেখা যায়। ফলে তাদের পক্ষে বৃদ্ধ মা-বাবার খরচ বহন করাও অনেকটা দূরহ হয়ে পড়ে। যার ফলে নিম্নবিত্ত ও গরিব জনগোষ্ঠীর অনেক প্রবীণ ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে থাকে। কর্মহীন জনগোষ্ঠীর এই চাপে  সমাজে নানারূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশের সামাজিক ঐতিহ্যে সাধারণত: বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা পুত্রসন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়। প্রবীণ বয়সে পিতা-মাতা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। তারমধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাড়ক্ষয়, শ্বাসকস্ট, এজমা, কিডনির অকার্যকারিতা, ক্যান্সারসহ নানারূপ বার্ধক্যজনিত রোগ। পরিবারে যথার্থ উপার্জনক্ষম সন্তান না থাকলে পিতামাতার ভরণপোষণের পর এই সমস্ত ব্যয়বহুল খরচের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়ে। এর ফলে প্রবীণ ব্যক্তি নিজের পরিবারে আপনজন কর্তৃক নানা অবহেলা ও নিপীড়নের শিকার হন। অনেক পরিবারে এমনও দেখা যায় পিতা-মাতাকেই বৃদ্ধ বয়সে সন্তান-সন্ততির ব্যয়ভার বহন করতে হয়। সে কারনে আমরা অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও উপার্জনের জন্য রিক্সা চালক, ফেরিওয়ালা কিংবা অন্য কোনো কায়িক পরিশ্রমে জীবন যাপন করতে দেখি। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য নীতিনির্ধারকদের পূর্ব থেকে সতর্ক না হলে আগামী সময়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।

ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় একটি সাংবাৎসরিক বিষয়। প্রতিবছর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঝড় ও নদীভাঙ্গনে ভিটে-মাটি ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এইসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠী। ক্ষুধা, আশ্রয়হীনতা, রোগশোকে আক্রান্ত এই জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে সাহায্য দেওয়া হয় তা চাহিদার তুলনায় একবারে অপ্রতুল। ফলে জীবন-ধারনের জন্য এই জনগোষ্ঠী আশ্রয় নেয় ভিক্ষাবৃত্তিতে। ক্ষুধা, আর্থিক সামর্থহীনতা, আশ্রয়ের অভাবে প্রবীণ এই নিপিড়ীত জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাংলাদেশে আশ্রয়হীন এসব জনগোষ্ঠীর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান অদ্যাবধি তৈরি করা হয়নি। উপকুলীয় অঞ্চলে জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচে ক্ষতিগ্রস্ত। এ ছাড়া জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণঅঞ্চলের জনজীবনে তীব্র নিরাপদ পানির অভাব রয়েছে।

ঐবষঢ় অমব এষড়নধষ ঘবঃড়িৎশ এর গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বব্যাপী প্রতি ৬ জন প্রবীণ ব্যক্তির মধ্যে একজন নীপিড়নের শিকার হচ্ছে। এই তথ্য সত্য হলেও বাস্তবে বৃদ্ধদের প্রতি নিপীড়ন অনেকটাই দৃশ্যের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন ঘটনায় বৃদ্ধদের প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও অবহেলা বৃদ্ধির চিত্র ক্রমাগত পরিলক্ষিত হচ্ছে। মিডিয়ার বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা গেছে চলাচলে অক্ষম বৃদ্ধ মা-বাবাকে সন্তান-সন্ততিরা কোনোরূপ ভরণপোষণ করছে না এবং কখনো কখনো রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন কিংবা বাসস্টেশনে ফেলে নিরুদ্দেশ হচ্ছে। এসব মাতা-পিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্মৃতিভ্রষ্ট থাকে কিংবা রাস্তা-ঘাট অপরিচিত থাকায় নিজের আশ্রয়স্থলে ফিরে যেতে অক্ষম। বৃদ্ধদের প্রতি এ ধরনের আচরণ পরিবারের অতি নিকটজন যেমন করে থাকে তেমনি বৃদ্ধাশ্রম ও অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রের পরিচর্যায় নিযুক্ত সেবাকর্মীর মাধ্যমেও হতে পারে। বিশ্ব প্রবীণ দিবসে এ ধরনের নিপীড়ণের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং নিপীড়ন বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে মাতা-পিতার প্রতি এ ধরনের নিপীড়ন বন্ধে বাংলাদেশ সরকার মাতা-পিতা ভরণ পোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করে থাকলেও বাংলাদেশের নিপীড়িত মাতা-পিতরা সন্তানের বিরুদ্ধে কোনোরূপ আইনের আশ্রয় নিতে চায় না।

শারিরীক আঘাত, ক্ষতিকর ড্রাগের ব্যবহার, আশ্রয়স্থলে কিংবা অন্য কোনোভাবে আবদ্ধ করার মাধ্যমে।  ভীতিপ্রদর্শন, অবমাননা করা , অকারণে প্রাত্যহিক দোষারূপ, অবহেলা, ভৎর্সনা, পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধব থেকে পৃথক করে রাখা। আশ্রয়কেন্দ্রে সেবাদানকারী ব্যক্তির মাধ্যমে কিংবা পরিবারে নিকট আত্মীয়ের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ণের শিকার। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সঠিকভাবে খাদ্য, নিরাপদ পানি, আশ্রয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ না করা, প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় কর্মে কিংবা অন্যসব জরুরি কর্মে সহায়তা না করার মাধ্যমে। বৃদ্ধ কিংবা প্রবীণব্যক্তির অগোচরে তার অর্থকড়ি, সম্পদ ভোগ করা এবং অর্থের ব্যবহারে তাদের সম্মতি না নেয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশ সরকার দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে এবং পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি চালু করে। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ৪৯ লক্ষ বয়স্ক ব্যাক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতাকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য ’পিতামাতা ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে, পিতামাতার একই সংগে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে, পিতামাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না, পিতা-মাতার চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। পিতামাতার অবর্তমানে বৃদ্ধ দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরণ-পোষণ করবে। এছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য মাসিক পেনসনের ব্যবস্থা রয়েছে। সরকার প্রবীণদের কল্যাণে নানা কর্মসূচি চালু করলেও জনসংখ্যা অনুপাতে তা নিতান্তই অপ্রতুল। প্রবীণরা সমাজের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও মেধাকে নিয়োজিত করে সমাজের ইতিবাচক কল্যাণ ও সুফল বয়ে আনতে পারে। সমাজে প্রতিটি প্রবীণের মর্যাদা ও নিরাপত্তার সাথে পরিপূর্ণ জীবন ভোগ করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তাদেরকে শারিরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে হবে। লেখক : হোসনেআরা আক্তার, সভাপতি, পূর্ণায়ু সিনিয়র সিটিজেনস সমাজকল্যান সংস্থা             (পিআইডি ফিচার)