সুন্দরবনের পর্যটন খাতে চরম বিপর্যয়

2
Spread the love

পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবীতে বৃহস্পতিবার সকালে ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অফ সুন্দরবন’র ব্যানারে খুলনার বয়রায় অবস্থিত বনবিভাগের সিএফ কার্যালয় ঘেরাও

স্টাফ রিপোর্টার >>

করোনা মহামারীর বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত সুন্দরবন কেন্দ্রিক পর্যটন খাত। টানা পাঁচ মাস ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা নেই বনে। এ অবস্থায় পর্যটক শূন্য সুন্দরবনের দর্শনীয় স্থানগুলোতে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। ম্যানগ্রোভ এ বনাঞ্চলকে ঘিরে গড়ে ওঠা ট্যুরিজম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লঞ্চ, ট্যুর বোট ও ট্রলারসহ সহস্রাধিক নৌযান অলস পড়ে আছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার নৌ শ্রমিক-কর্মচারী। অপরদিকে এ অবস্থা অব্যাহত থাকায় পর্যটন খাতে বন বিভাগের রাজস্ব আয়েও ভাটা নেমেছে।

বন বিভাগের সূত্র মতে, ‘বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ)’ সুন্দরবন প্রাণ-প্রাকৃতির আধার। নৈসর্গিক এ বনাঞ্চলকে ঘিরে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের রয়েছে নানা কৌতূহল। প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসেন এখানে। সুন্দরবনের করমজল, কটকা, কচিখালী, হারবাড়িয়া, হিরনপয়েন্ট, দুবলা, আলোরকোল ও নীলকমলসহ সমুদ্র তীরবর্তী এবং বনাঞ্চলের ছোট ছোট নদী-খালের জলরাশিতে লঞ্চ, ট্যুর বোট, ট্রলার ও বিভিন্ন নৌযানে চড়ে বছরজুড়েই যাতায়াত দর্শনার্থীদের। সুন্দরবনের এ পর্যটন খাতকে ঘিরে মোংলাসহ আশপাশের এলাকার হাজারও মানুষের কর্মসংস্থান। কিন্তু করোনা মহামারীতে সব কিছুই থমকে গেছে। ২৫ মার্চ থেকে সুন্দরবনের পর্যটকদের যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বন বিভাগ। তাই ট্যুর লঞ্চ, জালিবোট, ট্রলার ও নৌকাসহ দুই হাজার নৌযান এখন অলস পড়ে আছে। এতে ইঞ্জিন বিকলসহ ঘাটেই নষ্ট হতে বসেছে অধিকাংশ ট্যুর নৌযান। একই সঙ্গে এ খাতে জড়িত ব্যবসায়ীরা এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। অপরদিকে পর্যটকদের যাতায়াত না থাকায় দর্শনীয় স্থানগুলোর পন্টুন, কাঠের পুল ভেঙে পড়ছে। খসে পড়ছে বিভিন্ন স্থাপনা। আর এ নিয়ে তেমন নজরদারিও নেই বন বিভাগের

পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবীতে বৃহস্পতিবার সকালে ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অফ সুন্দরবন (TOAS) এর ব্যানারে খুলনার বয়রায় অবস্থিত বনবিভাগের সিএফ কার্যালয় ঘেরাও কর্মসুচি পালন করবে ভুক্তভোগীরা।  ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অফ সুন্দরবন (TOAS) সভাপতি মো. মইনুল ইসলাম জমাদ্দার জানান, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ট্যুরিজম পেশার সাথে প্রায় ৫হাজার পরিবার জড়িত। এসব পরিবারের বিকল্প কোন পেশা না থাকায় পরিবারগুলো সাড়ে ৫মাস সর্ম্পুন বেকার। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে এতদিন পরিবারের ভরণপোষন করলেও বর্তমানে অনেকেই অর্ধাহারে অনাহারে দিনযাপন করছে। ওই সব পরিবারগুলো কথা চিন্তা করে আমরা বিষয়টি স্থানীয় সংসদ সদস্য সেখ সালাউদ্দীন জুয়েল সাহেবের কাছে জানালে তিনি আন্তরিকতার সাথে জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়াও আমরা জেলা প্রশাসক বরাবরে ০১ সেপ্টেম্বর আবেদন করেছি। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসকের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও বনবিভাগ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি আরো জানান বিগত ৫ মাসে হরিন ও মৎস্য শিকার অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গেছে। সভাপতি মইনুল ইসলাম আরও বলেন, ম্যানগ্রোভ এ বনাঞ্চলকে ঘিরে গড়ে ওঠা ট্যুরিজম ব্যবসায়ীদের, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধাভোগীর কথা মাথায় রেখে অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের ন্যায় অতিসত্ত্বর সুন্দরবন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া এখন সময়ের দাবী।

এ বিষয়ে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের কর্মকর্তা মো. আজাদ কবির হাওলাদার জানান, পর্যটন কেন্দ্রের স্থাপনা, পন্টুন ও পুল সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চেয়ে বন বিভাগের ওপরের মহলে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে সংস্কার কাজ শুরু করা হবে। মোংলার ‘দ্য সাউদার্ন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভলর্সের’ স্বত্বাধিকারী মো. মিজানুর রহমান জানান, বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞা টানা পাঁচ মাস ধরে বলবৎ থাকায় একদিকে যেমন পর্যটন খাতে বন বিভাগের রাজস্ব আয়ে ভাটা পড়েছে। অপরদিকে পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে মোংলাসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা হোটেল, মোটেল এবং বনকেন্দ্রিক কটেজগুলো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগ আর দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন পর্যটক পরিবহনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন নৌযানের মালিক ও শ্রমিক-কর্মচারীসহ কয়েক হাজার পরিবার। বিগত বছরগুলোতে সুন্দরবনে পশ্চিম ও পূর্ব বিভাগে গড়ে দুই লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম ঘটে। আর বছরে গড় রাজস্ব আয়ও দুই কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে থাকে। এ প্রসঙ্গে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন গনমাধ্যমকে বলেন, পর্যটন খাতে রাজস্ব আয়ের সিংহ ভাগ আসে পূর্ব বন বিভাগ থেকে। কিন্তু এ অংশে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দর্শনার্থী থেকে কিছুটা আয় হলেও এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ মাসে বন বিভাগের রাজস্ব আয় শূন্যে দাঁড়িয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সুন্দরবনের পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি। সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খাঁন জানান, বন, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনের পর্যটন খাত বন্ধ রাখা হবে। কবে নাগাদ আবারও সুন্দরবনে পর্যটকদের যাতায়াত শুরু হবে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি বন বিভাগের এ কর্মকর্তা।

এ বিষয় সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সীমিত আকারে সুন্দরবনের পর্যটন শিল্প পরীক্ষামূলকভাবে খুলে দেয়া যেতে পারে। এতে পর্যটন শিল্পের অর্থনীতিতে গতি ফিরবে এবং দীর্ঘদিন বেকার থাকা মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আর এখনই বনাঞ্চলের দর্শনীয় স্পটগুলো উম্মুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।