বিশেষ প্রতিনিধি
বাজারে মোটেও সংকট নেই, উৎপাদনও হয়েছে বিপুল পরিমাণে, আমদানিও হয়েছে হাজার হাজার ট্রাক। তারপরও ভারত সরকারের ঘোষণা শুনেই কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী একদিনেই অস্থির করে ফেলেছে সারা দেশের পেঁয়াজের বাজার। প্রশাসনও কঠোর অবস্থানে রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় শুরু হয়েছে পেঁয়াজের আড়তদার ও খুচরা দোকানদারদের বিরুদ্ধে অভিযান। সারা দেশ থেকেই এসব খবর জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। ভুক্তভোগীরা জানান, গত বছরের অভিজ্ঞতার পর এ বছর দেশে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এত বেশি উৎপাদন যে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মিসর, তুরস্ক ও প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দেশের বাজারে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ থাকা সত্ত্বেও ভারত আবারও পণ্যটি রফতানির ঘোষণা দিলে দেশের কৃষকরা তাদের স্বার্থ নষ্ট হওয়ার ভয়ে আমদানি না করতে সরকারের কাছে আবেদনও জানিয়েছিল। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও প্রথমে বলেছিলেন, ভারতের পেঁয়াজ আর নেবেন না। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও বলেছিলেন, দেশে যথেষ্ট পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে, এ বছর পেঁয়াজের সংকট হবে না। এরপরও নানা পক্ষের চাপ ও ভবিষ্যতের প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে গত মার্চের শুরুর দিকেই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। গত ২৭ মার্চ করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার আগেই দেশের ভেতরে চলে আসে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পেঁয়াজ। এমনকি কাঁচাপণ্য হওয়ার কারণে লকডাউনের মধ্যেও হিলি, পেট্রাপোল ও ভোমরা বন্দরের ওপারে আটকে থাকা পেঁয়াজবাহী ভারতীয় ট্রাকগুলোকে পণ্য খালাস করার অনুমতি দেওয়া হয় বিশেষ বিবেচনায়। লকডাউনের পরও ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে তার ৭০ শতাংশই পেঁয়াজ। অথচ ভারত সরকার হুট করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিতে না দিতেই আবারও অস্থিরতা শুরু হয়েছে পেঁয়াজের বাজারে।
মুনাফাখোর ব্যবসায়ী কারা?
কথায় কথায় বলা হয়, মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। তো এই মুনাফাখোর ব্যবসায়ী কারা? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আমদানিকারক, পেঁয়াজের আড়তদার- মূলত এদের দায়ী করা হলেও মুনাফালোভী আসলে প্রতিটি বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী থেকে গলির দোকানদাররাও। গতকাল ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে ও রাতে আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন দিয়ে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব দোকানদারের বেশিরভাগই নতুন করে আড়ত থেকে কোনও পেঁয়াজ না কিনেই আগে তাদের স্টকে থাকা পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এ ঘোষণাকে ধান্দা হিসেবে নিয়ে ক্রেতাদের ওপর চড়াও হয়েছেন তারা। স্বাভাবিক ব্যবসায়ের বদলে হুজুগ তুলে এমন মুনাফা লোটার চেষ্টা ধর্মীয়ভাবে গর্হিত, রাষ্ট্রের আইনেও অসাধু কারবার হিসেবে চিহ্নিত।
দেশজুড়ে প্রশাসনের অভিযান শুরু:
পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকটটি গত বছরও এসব অসাধু ব্যবসায়ী করেছিল। ফলে তাদের চিহ্নিত করা এ বছর প্রশাসনের পক্ষে মোটামুটি সহজ। এ কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় পেঁয়াজের আড়ত, পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোতে অভিযান চালিয়েছে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সবখানেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারকরা কাউকে শাস্তি দেওয়ার আগে তার কাছে বর্ধিত মূল্যে পেঁয়াজ কেনার চালানপত্র বা ইনভয়েস দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু দেশের কোথাও বর্ধিত মূল্যে বা উচ্চমূল্যে পেঁয়াজ কেনার কোনও চালানপত্র বা মেমো বা ইনভয়েস দেখাতে পারেননি দোকানদাররা। এ কারণেই অতি মুনাফালোভী এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও জরিমানা করে তা আদায় করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, আদালতগুলোর এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে। বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ পেঁয়াজ আড়তে মজুত রেখে হুট করে দাম বাড়ানোর কারণে বেনাপোলের ৩ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার ম-ল।
মঙ্গলবার (১৫ সেপ্টেম্বর) বিকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার ম-ল এ আদালত পরিচালনা করেন। আদালত জরিমানাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মেহেরাব স্টোরের মালিক সুরুজ মিয়াকে ভোক্তা অধিকার আইনের ৩৮, ৩৯, ৪০ ধারায় ১৫ হাজার টাকা, মেসার্স খান এ সবুর বাণিজ্যভা-ারের মালিক সবুর খানকে ৫ হাজার টাকা ও মিম বাণিজ্যভা-ারের মালিক মো. শুকুর আলীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়।