বরেণ্য সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীত পরিচালক শাহ আলম বাদল

24
Spread the love

>> নাজমুল হক লাকি

খুলনা বেতারে স্বাধীনতা দিবসের একটি বিশেষ গীতি আলেখ্য রেকর্ড হবে! গীতিকার আবু জাফর এসে গেছেন। তিনি নিজেই সুরকার এবং নিজেই কন্ঠ দেবেন। সাথে আছেন ফরিদা পারভীন। তখনও তাঁদের বিয়ে হয় নি। ১৯৭৩-৭৪ সালের কথা! খুলনা বেতার তখন গল্লামারিতে। শেরে বাংলা রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে স্টুডিও। বাড়িটির নাম হাবেলী বাগ। ময়লাপোতা থেকে নিরালা আবাসিক এলাকায় যাওয়ার কিছুটা আগে মেইন রোডে হাতের ডানপাশে এর অবস্থান। দু’কামরা বিশিষ্ট ছোট্ট স্টুডিওতে সাজ সাজ রব। আঞ্চলিক পরিচালকসহ অফিসারবৃন্দ এবং স্টাফ-সবাই ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। গীটার, তবলা, হারমোনিয়াম ও বাঁশি ছাড়া আর কোন যন্ত্রপাতি নেই। পাকিস্তানিরা পরাজয়ের মুখে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ খুলনা বেতারের কাগজপত্র, টেপসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে গেছে।

রিহার্সেলের পর শুরু হলো রেকর্ডিং। আবু জাফর ও ফরিদা পারভীন মন-প্রাণ উজাড় করে গাইছেন-‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে…’ । কথা আর সুরের অপূর্ব ব্যঞ্জনায় সবাই মোহাবিষ্ট! মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন দেশের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার কথা। সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য অপরূপ এক মায়ায় সবার চোখে জল এসে গেল। তারপরের ইতিহাসতো সবারই জানা। ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা…’ গানটি প্রচারের পর দেশব্যাপি বিখ্যাত হয়ে গেল।

সেই গানের সাথে গীটারে সঙ্গত করছিলেন ২০-২১ বছরের এক তরুণ। গীটারে তাঁর জাদুকরী হাতের স্পর্শ খুলনা বেতারের ছোট্ট স্টুডিওতে উপস্থিত সবার হৃদয়তন্ত্রীকে নাড়িয়ে দিল। সেদিনের সেই তরুণ গীটারিস্টই শাহ আলম বাদল। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় জুনিয়র গ্রুপের গীটার বাদনে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক অর্জন করে এসেছেন। খুলনায় সঙ্গীতের নানা আয়োজনে তাঁরাই তখন খুলনার বিভিন্ন মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

১৯৭০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সুরস্রষ্টা শাহ আলম বাদল খুলনা বেতারের সাথে জড়িত। ১৯৭৩ সালে মাসিক চুক্তিভিত্তিতে যোগ দেন খুলনা বেতারে। দেশ বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ, কিংবদন্তী সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ তখন খুলনা বেতারে কর্মরত। গুণী এই সঙ্গীত পরিচালকের সংস্পর্শে এসে বদলে যায় তরুণ গীটারিস্ট শাহ আলম বাদলের জীবন বোধ। ভাবনাগুলো ডানা মেলতে শুরু করে। সঙ্গীত পরিচালক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে মন। ওস্তাদ সাধন সরকার, সঙ্গীত পরিচালক নূরুল ইসলাম মুফতির মত গুণী মানুষদের সার্বক্ষণিক সঙ্গ ও সহযোগিতায় তিনি ধীরে ধীরে দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন। তাঁদের স্নেহময় সাহচর্যে ১৯৭৫ সাল থেকেই তিনি বিভিন্ন গানের সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা পূর্ণতা পায় ১৯৮১ সালে খুলনা বেতারে সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে।

বেতার তখন শিল্পীদের স্বপ্নের প্ল্যাটফরম। অনেক রেওয়াজ ও সাধনা ছাড়া বেতারের শিল্পী হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না। যোগ্যতা ছাড়া কারও সুপারিশেও কাজ হতো নাা। টেলিভিশন সাধারণের নাগালের বাইরে হওয়ায় বিনোদনে বেতারই একমাত্র ভরসা। বেতারের শিল্পী, সুরকার, গীতিকারের নাম তখন খুলনার মানুষের মুখে মুখে থাকতো। বিভিন্ন আড্ডায়, চায়ের টেবিলে বেতার শিল্পীদের জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে আলোচনা হতো। বেতারের সেই গানগুলোই আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠতো যখন বেতার শিল্পীরা খুলনার বিভিন্ন মঞ্চে সেগুলো পরিবেশন করতেন।

১৯৭৫ সাল থেকেই শাহ আলম বাদলের সঙ্গীত পরিচালনায় শাম্মী আখতার, খালিদ হাসান মিলু, প্রণব ঘোষ, শেখ আব্দুস সালাম, সাইদুর রহমান সাঈদ, জায়বুন্নেসা, মেহেরুন্নেছা, অজয় কুমার দাস, এইচএম বাহালুল করিম, কামরুল ইসলাম বাবলু, গাজী সালাহউদ্দিন বাপ্পী, মোস্তাক আহমেদ, রোজী ইসলাম, মলিনা বিশ্বাস, মলিনা দাস, আব্দুস সবুর খান চৌধুরী এবং পরের প্রজন্মের নাহিদ সুলতানা, কামাল হাসান, সাহানা সুলতানা বিউটি, সাহারা ইরানী পিয়া, রূপা রাণী সাহা, মানষী সাধু, সালাউদ্দিন খানসহ অনেকের কন্ঠে ধারণ করা গান খুলনায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। স্বনামখ্যাত গীতিকবি আবুল হায়াত মোঃ কামাল, সৈয়দ আব্দুল মতিন, অচিন্ত্য কুমার ভৌমিক, মোঃ রেজাউল করিম, মোঃ জাকারিয়া, আব্দুর রশীদ, রফিকুর রশীদ, ফিরোজ খান নুন, অশোক কুমার দে, মোখলেসুর রহমান বাবলু, দিলরুবা মাসুদ, শিউলি মহিউদ্দিনের লেখা এবং শাহ আলম বাদলের বৈচিত্র্যময় সুরের সেসব গান দারুণ শ্রোতাপ্রিয় ছিল। আর সেসব গান সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মের কাছে ছিল বিশেষ কিছু। হৃদয় তোলপাড় করা গানের সেসব কথা দিয়েই তরুণ প্রজন্ম শব্দ সাজিয়ে চিঠি লিখতেন প্রেমিকার কাছে।

ইতোমধ্যে খুলনা বেতারের প্রচার পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় শাহ আলম বাদলের নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। দেশের বোদ্ধা সুরকাররাও তাঁর সুরের প্রশংসা করতে থাকেন। এর মধ্যেই তাঁকে অবাক করে দিয়ে ঢাকা বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস থেকে সঙ্গীত পরিচালনার আমন্ত্রণ এলো। তাঁর সুরে সৈয়দ আব্দুল মতিনের লেখা গান ‘হাজার দেশের এই পৃথিবী হাজার নদী গ্রাম…’ এন্ড্রু কিশোরের কন্ঠে বেতারে দেশব্যাপি দারুণ সাড়া ফেললো। এরপর তাঁর সুরে শাম্মী আখতার গাইলেন আবুল হায়াত মোঃ কামালের লেখা গান, ‘যে দেশের মাটির বুকে উর্বরতার প্রতিচ্ছবি..’ শাকিলা জাফর গাইলেন, ‘তুমি আমার মেঘলা মনের…’ ফাতেমা-তুজ-জোহরা গাইলেন,‘তুমি সুখে আছ, তুমি ভাল আছ…’ এন্ড্রু কিশোর গাইলেন, ‘দয়াল রে কত বছর কেটে গেল…’ । এছাড়া অনেক বিখ্যাত শিল্পীই তাঁর সুরে গান করেছেন। বেতারে প্রচারিত সেসব গান সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সেসময় শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকতো অমর সুর¯্রষ্টা শাহ আলম বাদলের সুর করা গান।

দেশ বরেণ্য সুর¯্রষ্টা, সঙ্গীত পরিচালক শাহ আলম বাদল ২০০৭ সালে বাংলাদেশ বেতারের প্রধান সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বেতারে। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন-যাপন করছেন এবং ঢাকাতেই থাকেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি খুলনা কালচারাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের গুণীজন সম্মাননা পদক, খুলনা সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংস্থার পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সম্মাননা ও পদক, যশোর সুর বিতান সঙ্গীত একাডেমির পক্ষ থেকে মোশাররফ হোসেন পদক, সঙ্গীতে অবদান রাখার জন্য খুলনার মেয়র পদক, নন্দন সঙ্গীত সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, ঢাকার পক্ষ থেকে একুশে সম্মাননা পদকসহ অসংখ্য পুরষ্কার অর্জন করেন।

দৈনিক খুলনাঞ্চলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বরেণ্য সঙ্গীত পরিচালক শাহ আলম বাদল বলেন, ‘সঙ্গীত জীবনের দীর্ঘ পথ চলায় খুলনা বেতারই আমাকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের চূড়ায়। স্মৃতিময় খুলনা শহর আর খুলনার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের কথা আমি সবসময় কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। খুলনা বেতারে আমার দুই সহকর্মী অকাল প্রয়াত মোঃ শওকত হোসেন ও তৌহিদ হাসান ফারুকী বাবুর সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা কোনদিনই ভুলতে পারি না। যতদিন বেঁচে থাকি খুলনার মানুষ ও খুলনা বেতার মিশে থাকবে আমার আত্মায়।’

আজ মহান সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীত পরিচালক শাহ আলম বাদলের জন্মদিনে তাঁকে আমরা স্মরণ করছি আন্তরিক ভালবাসায়। গভীর শ্রদ্ধায়। সঙ্গীতভুবনে খুলনার ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায়।