শরীফুল ইসলাম:
দলের ইমেজ সঙ্কট কাটাতে ইতিবাচক রাজনীতির চেষ্টায় বিএনপি। অতীতে দলের যে সব কর্মকান্ড নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে এমন রাজনীতি পরিহার করে এখন নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। এরই অংশ হিসেবে দলের সর্বস্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি ও প্রতিটি কমিটিতে ৩৩ নারীকে স্থান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
সূত্র মতে, অতীতের বিভিন্ন কর্মকান্ডে দেশ-বিদেশে বিএনপির ইমেজ সঙ্কট দেখা দেয়। এর ফলে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। এ অবস্থানের অবসানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপিকে রাজনৈতিক গতিধারা পরিবর্তনের তাগিদ দেয়া হয়। বিশেষ করে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা দলের ইমেজ সঙ্কট বৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক রাজনীতির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
সূত্র জানায়, শনিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আড়াই ঘণ্টাব্যাপী ভার্চুয়াল বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি কিভাবে দলকে ইতিবাচক রাজনীতিতে ফিরিয়ে সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় সে বিষয়টি প্রাধান্য পায়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতারা ইতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেন। ইতিবাচক রাজনীতি জোরদারের অংশ হিসেবে দলের পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিল সামনে সারাদেশের সর্বস্তরে দলের কমিটি কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত হয়। করোনা পরিস্থিতির আরেকটু উন্নতি হলে সর্বস্তরে কমিটি গঠনের কাজ শুরু করবে বিএনপি। এ জন্য সিনিয়র নেতাদের দিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হবে, যে কমিটি সারাদেশের সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ তদারকি করবে। ইতিবাচক রাজনীতির অংশ হিসেবেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী দলের প্রতিটি কমিটিতে ৩৩ ভাগ নারী রাখারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে একবারে না করে ধাপে ধাপে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। উন্নত বিশ্বের ন্যায় দেশের নারী সমাজকে প্রাধান্য দিয়ে এ কমিটি করা হবে।
এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়, যেখানে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী সেখানে দলের কমিটিতে ৩৩ ভাগ নারীকে স্থান দেয়া হলে নারীদের মধ্যে দলের রাজনীতি সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হবে। এতে বিএনপিই লাভবান হবে। এ ছাড়া সাবেক ছাত্রদল ও মহিলাদল করা অসংখ্য যোগ্য নারীনেত্রী রয়েছেন। যাদের বিএনপির বিভিন্ন স্তরে স্থান দিলে তারা তাদের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা দিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে পারবে। এদিকে বিএনপির সাংগঠনিক কার্জক্রম বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এর ফলে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে স্থবির হয়ে পড়েছে দলটি। এ পরিস্থিতিতে আবার নতুন উদ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরুর পাশাপাশি মাঠের রাজনীতিও জোরদার করতে চায় তারা। এ জন্য নানামুখী কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে দলীয় হাইকমান্ড। ইতোমধ্যেই সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর কাছে কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। মূলত কোরবানির ঈদের পর থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করতে চায় বিএনপি।
৪ বছর ৪ মাস ধরে জাতীয় কাউন্সিল না হওয়ায় বিএনপির নির্বাহী কমিটি এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। এ ছাড়া সারাদেশের জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অধিকাংশ কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর অনেক আগে থেকেই সাংগঠনিক কার্যক্রমের গতি থামিয়ে দেয় বিএনপি। আর করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে এসব কমিটিতে থাকা নেতাকর্মীরা দলবিমুখ হয়ে পড়ায় সর্বস্তরের সাধারণ নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়ে দলীয় কর্মকা- থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। এ অবস্থার অবসানে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করবে দলটি। উল্লেখ্য, ক্ষমতায় থাকাকালে একের পর এক রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ হয় দেশের মানুষ। দেশের বাইরেও বিএনপির রাজনীতি নিয়ে সমালোচনা হয়। এক পর্যায়ে ক্ষমতা ছাড়ার পর ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশ দলীয় হাইকমান্ডের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে সংস্কারপন্থী বিএনপি নামে দলকে ব্র্যাকেটবন্দী করে।
এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি চরম সঙ্কটে পতিত হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কারপন্থী বিএনপির কার্যক্রম গতিহীন হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতে অনেকেই আবার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন মূল দলে ফিরে আসেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। কিন্তু তখন দলটি নাজুক পরিস্থিতিতে থাকায় নির্বাচনে ভরাডুবি হয়। এ নির্বাচনে পরাজয়ের পর দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা হতাশ হন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করে বিএনপি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। রাজপথের আন্দোলনেও গতি সঞ্চার করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো নিয়ে ২০১৩ সালের শেষদিকে জ্বালাও-পোড়াওসহ নেতিবাচক আন্দোলন শুরু করে তারা। কিন্তু সরকার কঠোর হস্তে এ আন্দোলন মোকাবেলা করায় এক পর্যায়ে বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হয়। কিন্তু নেতিবাচক আন্দোলনের কারণে দেশে-বিদেশে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ায় বিএনপি জোটের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আলোর মুখ দেখেনি। এর ফলে আওয়ামী দলীয় সরকারের অধীনেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ফেলে।
রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকা এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটও এ নির্বাচন বর্জন করে। তবে নির্বাচনের দিন বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে অগ্নি সংযোগ করে আবারও সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথম এক বছর একেবারে চুপ করে থাকে বিএনপি। রাজপথে কোন কর্মসূচীই পালন করেনি দলটি।
কিন্তু একবছর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচী পালন শুরু করে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের শরিক দলও এ আন্দোলনে শরিক হয়। আন্দোলন শুরুর আগেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কিছু নেতাকর্মীকে নিয়ে গুলশানের বাসা থেকে বের হয়ে দলের গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন। ঘোষণা দেন সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তিনি বাসায় ফিরবেন না। ৯২ দিনের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে রাজপথে পেট্রোলবোমাসহ জ্বালাও-পোড়াও সহিংস আন্দোলন করে। এতে দেড় শতাধিক মানুষ মারা যায়। আহত হয় অনেক মানুষ। পেট্রোলবোমা মেরে জালিয়ে দেয়া হয় সহস্রাধিক যানবাহনসহ সরকারী-বেসরকারী অনেক স্থাপনা। এ পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশে বিএনপির রাজনীতি নিয়ে চরম নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে কর্মসূচী স্থগিত করে গুলশান কার্যালয় থেকে বাসায় ফিরে যান খালেদা জিয়া। এর পর সরকারও বিএনপির প্রতি কঠোর হয়। তাই রাজপথে জোরালো কোন কর্মসূচী নিয়ে আর নামতে পারেনি দলটি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম আরও ঝিমিয়ে পড়ে। লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে সীমিত পরিসরে সাংগঠনিক কার্যক্রম চললেও এ নিয়ে নানান সমস্যা দেখা দেয়ায় এক পর্যায়ে গতি থেমে যায়। এর ফলে সরাদেশের সর্বস্তরে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করে।
খালেদা জিয়াকে জেলে রেখেই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি ও তাদের জোট সঙ্গীরা। তবে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে দল ও জোটের সাধারণ নেতাকর্মীরা মাঠে সক্রিয় না থাকায় শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে বিএনপি জোট। তবে রাজপথে আন্দোলনের চেষ্টা করেও নেতাকর্মীদের সায় না থাকায় অগ্রসর হতে পারেনি বিএনপি। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা ও দলীয় ৭ এমপি সংসদে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্তের পর আবারও সর্বমহলে নিন্দিত হয় বিএনপি।
এক পর্যায়ে তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে দলীয় এমপিরা সংসদে যোগ দিলে বিএনপির অন্য নেতারা ক্ষুব্ধ হন। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সব নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কিছুটা খুশি হন। কিন্তু অতীতের ভুল রাজনীতির কারণে বিএনপি আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এক পর্যায়ে তৃণমূল পর্যায়ে কাউন্সিল ছাড়া দল গুছাতে গিয়ে হোঁচট খায়। এ বছর মার্চ থেকে দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরু হলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েই সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।
স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে ৬ মাসের জন্য মুক্তি পান। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সর্বক্ষণিক গুলশানের বাসা ফিরোজায় অবস্থান করলেও বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। আবারও মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া যায় কিনা এমন চিন্তাভাবনা থেকে তিনি এখন দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করছেন। তবে তিনি দলের নেতাদের ইতিবাচক কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন মহল থেকে ইতিবাচক রাজনীতি জোরদার করার তাগিদ ছিল। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও ইতিবাচক রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি দলের সর্বস্তরে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে আরও অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই রাজনৈতিকভাবে অধিকতর সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করবে বিএনপি।-জনকন্ঠ