র‌্যাবের অভিযানে সাহেদ গ্রেফতার

3

>> সাতক্ষীরা সীমান্তের কোমরপুর গ্রাম দিয়ে ভারতে পালাচ্ছিল >> পরনে ছিল বোরকা >> ঢাকায় এনে উত্তরায় অভিযান, জাল টাকা উদ্ধার পরে ডিবিতে হস্তান্তর

ঢাকা অফিস :

টানা নয়দিন আত্মগোপনে থেকে ভারতে পালানোর সময় সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকায় ধরা পড়েছে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান, দুর্ধরষ প্রতারক সাহেদ। বুধবার ভোর ৫টা ১০ মিনিটে দেবহাটা থানার কোমরপুর গ্রামে লবঙ্গবতী খালের পাশ থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় তিনি নদী পার হয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। স্থানীয় কয়েকজনের সহায়তায় সাহেদ নৌকায় ওঠার পর পরই তাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেন র‌্যাব সদস্যরা।

তাকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় নেয়া হয়। পরে তাকে নিয়ে উত্তরায় তার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে লক্ষাধিক জাল টাকাসহ মূল্যবান নানা কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। সাহেদকে গ্রেফতারের খবর মুহূর্তেই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। তাকে গ্রেফতার করতে পারায় স্বস্তি নেমে আসে আইনশ্ৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঝে। কেননা, করোনার মতো মরণব্যাধির চিকিৎসায় হাজার হাজার রোগীকে প্রতারণার অপরাধে এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিল দেশবাসী। এমন ভয়ঙ্কর প্রতারক রিজেন্টে অভিযানের সময় ধরা না পড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা দেখা দেয়। এটা র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর জন্যও ছিল বিব্রতকর। বুধবার ভোরে এসবের অবসান ঘটে।

বুধবারই বিকেল সাড়ে চারটায় তাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। পাঁচটার সময় হঠাৎ সে অসুস্থবোধ করলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বুধবার বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে তাকে ঢামেকে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চার নম্বর কক্ষে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর তাকে ডিবিতে নেয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার সাহেদের দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন জানাবে ডিবি। গায়ে কালো রঙের বোরকা। পরনে জিন্স। মাথায় গামছা জড়ানো। দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীর তীর এলাকায় মঙ্গলবার রাত থেকে এই সাজে অবস্থান করে পলাতক আসামি সাহেদ করিম।

বুধবার ভোর ৫টা ১০ মিনিটে র‌্যাবের বিশেষ অভিযানে দেবহাটা উপজেলার শাঁখরা কোমরপুর থেকে অবৈধ অস্ত্রসহ বোরকা পরিহিত অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। জনৈক বাচ্চু দালালসহ কয়েক দালালের মাধ্যমে সীমান্ত নদী ইছামতি দিয়ে নৌকায় ভারতে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার সময় তাকে আটক করে। আগে থেকে নজরদারিতে রাখে র‌্যাবের একটি চৌকস দল। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল আহমেদ বুধবার সকালে সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে এক প্রেসব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। প্রেসব্রিফিং শেষে সকাল ৮ টায় র‌্যাবের হেলিকপ্টারযোগে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, সাহেদ করিম তার চুল ও গোঁফ কেটে ও ছেঁটে ছোট করে ফেলে এবং চুলে কালো রং করে। আটকের সময় তার পরনে বোরকা ছিল।

সাহেদ করিম ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, র‌্যাব-৬, সাতক্ষীরা ক্যা¤প কমান্ডার সিনিয়র এএসপি বজলুর রশিদের নেতৃত্বে র‌্যাবের একটি চৌকস দল তাকে চ্যালেঞ্জ করে। আটকের সময় তার সঙ্গে র‌্যাব সদস্যদের ধস্তাধস্তি হয়। আটকের পর সাহেদের শরীরে কাদামাটি মাখা দেখা যায়। সাহেদকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সহায়তার সঙ্গে জড়িত সাতক্ষীরা সীমান্তে মানুষ পাচার ও চোরাকারবারে জড়িত কয়েক দালালকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মাধ্যমেই সাহেদ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তার কাছ থেকে এ সময় একটি অবৈধ পিস্তল ও ৩ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। তাকে ঢাকায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। কয়েকদিন ধরে তাকে গ্রেফতারের জন্য সাতক্ষীরার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে চিরুনি অভিযান চালায়।

এ সম্পর্কে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা গণমাধ্যমকে বলেন- ৯ দিন ধরে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছিল। ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তনের কারণে গ্রেফতারের খুব কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেও অল্পের জন্য মিস করেছি। পরশুদিন রাত থেকে তাকে অনুসরণ করে গ্রেফতার করা হয়। এলাকাবাসী জানিয়েছে, সাহেদকে ধরার আগে সাতক্ষীরায় মঙ্গলবার দিনেরাতে চলে পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিরুনি অভিযান। এই প্রতারক যাতে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য জেলাব্যাপী এই অভিযান চালানো হয়। জেলা পুলিশ সীমান্তে যাওয়ার পথে প্রায় সব গাড়িতে তল্লাশি চালায় দিনেরাতে। একই সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির পক্ষে সীমান্তে টহল ছিল জোরদার। পাশাপাশি চলে গোয়েন্দা নজরদারি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন- সন্দেহজনক মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ সব যানবাহনে তল্লাশি চালানো হয়। কোনভাবেই যাতে সাহেদ ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য এই অভিযান চালানো হচ্ছে। গোয়েন্দা খবর ছিল-সাতক্ষীরা দিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করবে সাহেদ। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান মঙ্গলবার জানান, সাতক্ষীরা শহরে কামালনগরের একটি ফ্যাটে গতরাতে অভিযান চালানো হয়েছে। সেখানে মোঃ সাহেদ সাতক্ষীরায় অবস্থানকালে থাকত। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা সদর থানায় ঢাকা যুগ্ম জজ ১ম আদালতের সিআর ১৪৮৮ নং মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তার ওয়ারেন্ট পেন্ডিং রয়েছে।

।। প্রত্যক্ষদর্শীর দৃষ্টিতে গ্রেফতার।।

এ ঘটনার বেশ কজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। তাদের অনেকেই ঘটনাস্থলে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। বর্ণনা দিয়েছে সাহেদকে ধরার ঘটনার। তাদেরই একজন দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম। তিনি একজন হোটেল ব্যবসায়ী। ফজরের নামাজের জন্য গিয়েছিলেন মসজিদে। নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই তাদের কানে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। শুরু হয় হইচই। ঘটনা কী দেখার জন্য দৌড়ে যান সবাই। গিয়ে যা দেখলেন সেটি তারা কল্পনাও করেননি আগে। সারাদেশের আলোচিত প্রতারক সাহেদ করিমকে ধরে ফেলেছে র‌্যাব। দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্য থেকে বোরকা পরা অবস্থায় সাহেদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে কোমরপুর গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা যখন নামাজ শেষ করেছি সেই মুহূর্তেই র‌্যাবের তিনটি গাড়ি দ্রুতগতিতে চলে গেল। ২/৩ মিনিট পরই আওয়াজ আসতে লাগল ধরে ফেলেছি, ধরে ফেলেছি। আমিসহ মসজিদের মুসল্লি ও এলাকার বাসিন্দা দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসি কী ঘটেছে দেখার জন্য। গিয়ে দেখি বর্তমানের আলোচিত প্রতারক সাহেদ করিমকে ধরে ফেলেছে র‌্যাব। হাতে হাতকড়া পরাচ্ছে তখন। কাছে একটি পিস্তলও পেয়েছে। তিনি ওই ব্রিজের পাশে একটি ছোট ড্রেন দেখিয়ে বলেন, ওখানে একটি নর্দমার মতো রয়েছে। সেই ড্রেনের ভেতরে বোরকা পরে শুয়ে ছিল প্রতারক সাহেদ। শোয়া অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় তার পরনে শার্ট, প্যান্ট ও বোরকা ছিল। কোমরে ছিল একটি পিস্তল। পরে র‌্যাব উপস্থিত জনতার সঙ্গে কথা বলে ও ছবি তুলে তাকে এখান থেকে নিয়ে যায়। র‌্যাব জানিয়েছে- সাহেদ জানত সে ধরা পড়বেই। এজন্য প্রতিনিয়ত নিজের বেশ পাল্টাত। চুলের রং পরিবর্তন করে সাদা চুল কালো করেছেন তিনি। গোঁফ কেটে কালো করে ফেলেছে। তার প্ল্যান ছিল মাথা ন্যাড়া করার। ভারতে গেলে হয়ত ন্যাড়া করে ফেলত। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। র‌্যাবের এডিজি বলেন, সাহেদকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কাজে সহযোগিতা করছিল একজন মাঝি, সে সাঁতরে পালিয়ে গেছে। তবে সাহেদ করিম মোটা হওয়ায় হয়ত দৌড়াতে পারেননি। যার কারণে তাকে আমরা ধরতে সক্ষম হয়েছি। বোরকা পরা অবস্থায় নৌকায় উঠে পালিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে আমরা ধরে ফেলেছি। তার কাছ থেকে একটি পিস্তল তিন রাউন্ড গুলি ও একটি ম্যাগজিন।

।।জনরোষের মুখে।।

গ্রেফতারের পর পরই জনরোষের কবলে পড়েন সাহেদ। তার প্রতারণার খবরে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ দেশের মানুষ। যার প্রতিফলন দেখা গেল সাহেদ গ্রেফতারের পরে। গ্রেফতারের পর র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে মারতে চেয়েছিলেন। সাতক্ষীরায় র‌্যাব যখন সাহেদকে ধরে নিয়ে আসছিলেন তখন এক কিশোর ভিডিও ধারণ করছিল। সেই কিশোর র‌্যাবের কাছে আবদার করে বলল- সবাই মিলে একটু মারলে হইত। অবশ্য র‌্যাব ওই কিশোরের আবদার রাখেনি। এ সময় র‌্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ওই কিশোরের মতো বেশ কয়েক এলাকাবাসী সাহেদের দিকে মারমুখী হন। কিন্তু র‌্যাবের বাধার কারণে তারা মারতে পারেননি।

।। ঘন ঘন স্থান বদল।।

সাতক্ষীরায় তার অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর গতরাত ২টা থেকে অভিযান শুরু করলেও ভোর ৫টা ১০ মিনিটে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। এর আগে বারবার অবস্থান পরিবর্তনের কারণে বেশ কয়েকবার সাহেদের কাছাকাছি গিয়েও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। সাতক্ষীরা থেকে সাহেদকে বহনকারী র‌্যাবের হেলিকপ্টার বুধবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। র‌্যাবের এডিজি বলেন- ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তনের কারণে সাহেদের কাছাকাছি কয়েকবার পৌঁছানো সম্ভব হলেও গ্রেফতার এড়াতে পেরেছেন তিনি। ৯ দিনের টানা চেষ্টার পর অবশেষে বুধবার ভোর ৫টা ১০ মিনিটে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীতীর সীমান্ত থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

কর্নেল তোফায়েল বলেন- সাহেদ স্থানীয় দালালের মাধ্যমে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। আমরা কিছু দালালের নাম পেয়েছি, এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। তিনি বোরকা পরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এর আগে, করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান, অর্থ আত্মসাতসহ প্রতারণার অভিযোগে সাহেদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বুধবার সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

।।উত্তরায় অভিযান।।

সাতক্ষীরা থেকে সাহেদকে নিয়ে রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের একটি ফ্যাটে অভিযান চালানো হয়। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে র‌্যাব এই অভিযান শুরু করে। তখন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরা ছিল। এর আগে ১২ টা ১৫ মিনিটে ওই ভবনে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম প্রবেশ করেন। সাহেদকে নিয়ে এই ভবনের ৪(এ) নম্বর ফ্যাটে অভিযান চালানো হয়। তবে এটি সাহেদের নিজস্ব ফ্যাট কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারেনি র‌্যাব। ভবনটি বুধবার সকাল থেকে ঘিরে রাখে র‌্যাব। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ৬২ নম্বর বাড়িতে এ অভিযান চালানো হয়। র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন- সাহেদের দেয়া তথ্যমতে ওই গোপন বাসা থেকে বেশকিছু কাগজপত্রসহ এক লাখের বেশি জাল টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। সরজমিনে দেখা যায়- বাসাটিতে অভিযানের আগে সাহেদের উপস্থিতিতে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেন র‌্যাব সদস্যরা। বাড়ির মালিক বলেন- প্রায় ১৫ মিনিট লাগে দরজা ভাঙ্গতে। দুই মাস আগে বাসাটি ভাড়া নেন সাহেদ। গত মাসের ভাড়াও দেয়নি সে। বাসায় রাতেরবেলায় আসত সাহেদ। এ সময় উত্তরা এলাকায় একাধিক প্রতারিত লোকজন আসতে শুরু করে। তারা জানান- পাওনা টাকা আনতে গেলে নানা হুমকি দিত। মুরাদ নামে এক ইলেক্ট্রিশিয়ানকে বেতনের টাকার চেক দিয়েছিলেন। সেটি ব্যাংকে দিলেও টাকা মেলেনি। পরে তার কাছে গেলে সে ওই ইলেক্ট্রিশিয়ানকে হুমকি দেয়।

।।র‌্যাবের ব্রিফিং।।

ঢাকায় এনে সাহেদকে নিয়ে অভিযান চালানো হয় উত্তরার একটি বাড়িতে। সেখান থেকে তাকে নিয়ে বেলা তিনটায় র‌্যাব সদর দফতরের বিশাল অডিটরিয়মে জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হন র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। দেশের প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল এই ব্রিফিং সরাসরি সম্প্রচার করে। বিপুলসংখ্যক সাংবাদিকদের সামনে র‌্যাব মহাপরিচালক সাহেদের গ্রেফতার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তবে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন। শুরুতেই তিনি বলেন- সাহেদ প্রতারণাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল বলার অবকাশ রাখে না। সে মূলত চুুর, ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু। সাতক্ষীরা থেকে আটক করে ঢাকায় আনার পর সাহেদ ও তার সঙ্গী গ্রেফতারকৃত মাসুদকে নিয়ে অভিযানে যায় র‌্যাব। সেখানে রিজেন্ট গ্রুপের এক কার্যালয় থেকে এক লাখ ৪৬ হাজার জাল টাকা উদ্ধার করা হয়। সে নিজেকে কখনও অবসরপ্রাপ্ত, কখনও চাকরিরত সেনা কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিত। কখনও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব পরিচয় দিত এবং সুকৌশলে ছবি তুলে সেটা ব্যবহার করত। এমনকি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, সাহেদ বালু, পাথর ব্যবসায়ীদের ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে প্রতারিত করেছে।

তিনি বলেন- সাহেদের বিরুদ্ধে অনেক মামলার বিষয়ে জানা গেছে। সেসবের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। বিনামূল্যে পরীক্ষা করার কথা থাকলেও ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা করে নেয়া হতো এবং পুনরায় পরীক্ষার জন্য ১০০০ গ্রহণ করত। আইসিইউতে ভর্তি করে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করত। এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের অধিক পরীক্ষা করে ৬ হাজার ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে সাহেদের প্রতিষ্ঠান। একদিকে রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, আরেকদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিলেও জন্য জমা দিয়েছে সাহেদের হাসপাতাল রিজেন্ট।

মহাপরিচালক বলেন- ভুক্তভোগী যারা আমাদের কাছে আসছেন তাদের আমরা আইনানুগ পরামর্শ দিচ্ছি। সহায়তা করছি, কীভাবে তিনি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য থানায় যাবেন বা আমাদের কাছে যদি আসতে চান আমরা সে সহায়তা প্রদান করছি। পালিয়ে থাকার সময় আমরা তাকে ফলো করেছি, সব পয়েন্ট যদি আমরা জানতে পারতাম তাহলে তখনই তাকে ধরতে পারতাম। আমরা যখনই জানতে পেরেছি এবং তাকে পিনপয়েন্ট করতে পেরেছি তখনই তাকে আমরা এ্যারেস্ট করেছি। ছয় মাস পরই আবার বেরিয়ে আসবে এ ধরনের কথা সাহেদ বলেছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন-এটা আমার ঠিক জানা নেই। অনেক কথা বলেছেন, যেটা আমরা তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে বলতে চাচ্ছি না। তদন্তের স্বার্থে কথাগুলো না বলাই শ্রেয় মনে করছি। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আজই সাহেদ করিমকে হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান তিনি।

রাজধানীতে বেশ কজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় সাহেদ আশ্রয় নিতে চেয়েছিল এ রকম কোন কর্মকর্তার পরিচয় পেয়েছেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন- এ রকম কোন তথ্য আমাদের কাছে জানা নেই। আপনার কাছে থাকলে জানালে আমরা দেখব। তিনি বলেন- কিছুদিন আগে আমরা এস এস এ হসপিটালে অভিযান পরিচালনা করেছি। এই হাসপাতালের মালিকের বিরুদ্ধে এবং যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। যেখানে আমরা তথ্য পাচ্ছি, সেখানেই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে হোক বা বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৎপর আছি। মামলার যিনি তদন্ত কর্মকর্তা আমরা তাকে হ্যান্ডওভার করব। পরবর্তী ব্যবস্থা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যিনি তদন্ত করবেন তিনি একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা তার মেধা, দক্ষতার আলোকে এবং আইনের আলোকে উনি তার ব্যবস্থা নেবেন। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে আমরা দেখছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাদের যেটা দরকার, তাদের যে টার্মস অব রেফারেন্স আছে সে অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন করছেন। সাহেদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রেখে এরকম একটা ছবি তোলার মধ্য দিয়ে র‌্যাব কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির মহাপরিচালক বলেন-এটা আমি দেখিনি, এটা পরে দেখে আমরা বলতে পারব। তিনি বলেন-আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে। যেখান থেকে আমরা তথ্য পাচ্ছি যাচাই-বাছাই করে ৬ তারিখের পরে ১২ তারিখও আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। কিন্তু এটা তো একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেখানেই আমরা সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দ তথ্য পাচ্ছি সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।

মহাপরিচালক বলেন- আপনারা দেখেছেন, তাকে গ্রেফতারের পর আমরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারপর ঢাকায় এসেছি। ঢাকায়ও তাকে নিয়ে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। আমরা উল্লেখ করেছি, জাল টাকা উদ্ধার করেছি। আমরা যে তথ্য পাই এই তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করি। যদি আমরা বিব্রতবোধ করতাম, তাহলে তো তাকে এ্যারেস্ট করে আনতাম না। বিব্রতবোধ করার কোন প্রশ্নই আসে না। আমাদের কাছে মামলার তদন্ত গ্রহণের জন্য যে প্রক্রিয়া আছে এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কার্যক্রম গ্রহণ করছি। বিগত কয়দিন সে কোথায় ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে চৌধুরী আব্দুল্লাহ মামুন বলেন-জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, একেকদিন একেক জায়গায় আত্মগোপনে ছিল। ঢাকা, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুকৌশলে আত্মগোপনে ছিল সে। দেবহাটার কোমরপুর সীমান্তে লবঙ্গবতী খাল দিয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করলে সে ধরা পড়ে। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।

সাধারণত অবৈধ অস্ত্রসহ ছিনতাইকারী, ডাকাত ও সন্ত্রাসী ধরা হলে তাদেরকে নিয়ে র‌্যাব অস্ত্র উদ্ধার করতে যায়। তখন কাউন্টার এ্যাটাকে তারা অনেক ক্ষেত্রে মারা যায়। সাহেদের বেলায় কেন এমনটি ঘটেনি। তাকে নিয়ে কি র‌্যাব অস্ত্র উদ্ধারে যেতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে চৌধুরী আব্দুুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা যা করার দরকার সেটাই করব। তদন্ত চলছে। তারাই দেখছে। তিনি আরও জানান- যেসব হাসপাতাল রিজেন্ট হাসপাতালের মতো অনৈতিক কর্মকা- করবে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। আমরা যখনই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাচ্ছি তখনই হাসপাতালে অভিযানে যাচ্ছি। গত ১২ জুলাইও রাজধানীর একটি হাসপাতালে অভিযান হয়েছে। আমাদের অভিযান চলছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। যদি কেউ এমন অপকর্মেও সঙ্গে জড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

কীভাবে এই প্রতারককে ধরা হলো সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে র‌্যাবের ডিজি বলেন, ইতোমধ্যে আপনারা জেনেছেন সাহেদ কী মানের প্রতারণার কাজ করতে পারে। কয়েকদিন ধরেই সে জায়গা পরিবর্তন করে চলছিল। আমরা তাকে ফলো করেছি। এবং সবশেষে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছি। ঢাকা কবে ছেড়েছে প্রশ্নে র‌্যাব মহাপরিচালক জানান, সে ঢাকা ছেড়েছে আবার ঢাকায় ফিরেছে, আবার বেরিয়েছে। এসবের মধ্যেই ছিল। এই পুরো সময়টাতে সে কখনও ব্যক্তিগত গাড়ি, কখনও হেঁটে, কখনও ট্রাকে চলাচল করছিল। অবশেষে নৌকায় পার হওয়ার সময় আমরা তাকে ধরতে সক্ষম হয়েছি।- সুত্র-জনকন্ঠ