-নাজনীন বেগম
করোনাভাইরাসের নিত্য সংক্রমণ বৃদ্ধি বর্তমান সময়ের এক অনভিপ্রেত দুর্যোগ। যার কঠিন বেড়াজালে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব। এখনও বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন লাখের ওপরে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমাগত উর্ধগতি। প্রাণঘাতী এই সংক্রমণকে কোনভাবেই ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা কম হলেও শনাক্তের পাল্লা বেশ ভারিই। পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হারও কম নয়। ২০ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। যা কোনভাবেই ভাইরাসটির কাবু হওয়ার লক্ষণ নয়। সুস্থতার সংখ্যাও আশাব্যঞ্জক। সেটা যেমন বৈশ্বিক চিত্র সমানভাবে বাংলাদেশেরও। আমাদের দেশে ৮ মার্চ থেকে রোগী শনাক্ত হলেও তা ছিল একেবারেই ধীরগতি। কিন্তু ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া এবং ২৬ মার্চ থেকে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটির ঘোষণায় কর্মযোগে যে স্থবিরতা নেমে আসে তা কিছুটা সহনীয় হলেও করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ছিল মূলত নেতিবাচক। সারাদেশ যখন সাধারণ ছুটির আওতায় তেমন সময়ে পুরো বাংলাদেশের জেলা, উপজেলা, গ্রামগঞ্জে কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনার সম্প্রসারণ শুরুই হয়নি। কিন্তু ছুটির মধ্যে যখন মানুষ গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার মিছিলে সংযুক্ত হলো তখন থেকেই এই বহুল সংক্রমণ রোগটি তার স্বভাব সুলভ বৈশিষ্ট্যে সারা বাংলাদেশ আক্রান্ত করার সুবর্ণ সুযোগটিও পেতে সময় নেয়নি। এপ্রিল মাস জুড়ে চলে মানুষের জেলা থেকে জেলান্তরে ঢুকে পড়ার হিড়িক। গণপরিবহনে উপচেপড়া ভিড় থেকে শুরু করে সড়ক-মহাসড়ক, নদ-নদীর ওপর দিয়ে যাতায়াতের যে অবর্ণনীয় দৃশ্য প্রতীয়মান হলো তখন থেকেই দেশের বিশিষ্টজনেরা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে আমলে নিতে সতর্ক এবং সাবধান বাণীও উচ্চারণ করলেন। সেভাবে কেউ তোয়াক্কাই করেনি।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও কেউ সেভাবে পালন করল না। অন্যভাবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো আর এক উপদ্রব সারাদেশকে হতবাক করে দিল। পোশাক শিল্প শ্রমিকদের দেশের বাড়ি চলে যাওয়ার ভিড় পরবর্তীতে আবার ঢাকার দিকে চলে আসার হরেক রকম ব্যবস্থা। কারণ সঙ্কটকালে পোশাক শিল্প-কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলেও ব্যবসায়িক স্বার্থকে পুঁজি করে আবার তা খুলে দেয়ার পাঁয়তারাও শুরু হয়ে যায়। সদ্য গ্রামে আসা শ্রমিকরা মুঠোফোনে বার্তা পায়- তাদের অতি সত্বর কাজে যোগ দিতে হবে। অন্যথায় চাকরি হারানো কিংবা বেতন কর্তনের আশঙ্কাও ঘনীভূত হবে। ফলে দলে দলে পোশাক শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে উদ্যোগী হলে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, রাস্তাঘাট, নদী পথ সব জায়গায় দৃশ্যমান হতে থাকে। তারা ফিরে আসতে এক প্রকার বাধ্য হয়। সেখানে থেকে পুনরায় নতুন কর সংক্রমণের যে আশঙ্কা দেখা দেয় তাও দেশের এক মহাবিপর্যয়। যার ঘানি এখনও আমরা টেনে চলেছি। শুধু তাই নয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চরম সঙ্কট পাশাপাশি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সার্বিক কাঠামোতে যে ভয়ঙ্কর বিপত্তি শুরু হয় সেটাকে ঠেকাতেও হিমশিম খাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ৩০ মে পর্যন্ত বহাল থাকার পর সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজকর্ম শুরু করার নির্দেশ আসে সরকারের পক্ষ থেকে। মাঝখানে পার করতে হয় পবিত্র রমজান এবং ঈদ-উল-ফিতর। ঢাকা থেকে মানুষের আসা আর যাওয়া কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হয়নি। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের সব জেলা-উপজেলায় এই সংক্রমণটি তার কালো থাবা বসিয়ে দিতে দেরিও করেনি। আবার ঈদের ছুটিত গ্রামের বাড়ি যাওয়া পুনরায় আবাসস্থল আর কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসা তাও সে সময়ের এক ভয়ঙ্কর দুর্বিপাক। তার নেতিবাচক প্রভাবে করোনা সংক্রমণ সম্প্রসারণে যে ভূমিকা রাখে তা এখনও চলমান। শুধু এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াতই নয় তার চেয়েও বেশি সামাজিক দূরত্ব প্রবলভাবে অবজ্ঞা করা এবং স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা না করাও করোনা সংক্রমণকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়।
সামনে অপেক্ষা করছে ঈদ-উল-আজহা। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য আরও এক অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এখানে শুধু আসা-যাওয়াই নয় কোরবানির জন্য পশুর হাট বসাও এক ধরনের নিয়মমাফিক পর্যায়। আর সারা বছর ব্যবসায়ীরা এই মহান উৎসবের অপেক্ষায় প্রস্তুতি নিতে থাকে। পশুপালন প্রক্রিয়ায় গরু, ছাগল প্রতিপালন ব্যবসায়ীদের বছরব্যাপী কর্ম সাধনার আবশ্যকীয় যোগ। অবশ্য রমজানের ঈদেও সীমিত আকারে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে আমলে নিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলেও তা তেমনভাবে জমেও ওঠেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক লোকসানও গুনতে হয়েছে। এবারও পশুর হাটে বেচা-বিক্রি কেমন হবে তা নিয়ে শঙ্কিত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বিক্রির সংখ্যা কমে গেলে পাল্লা দিয়ে মূল্য হ্রাসও দৃশ্যমান হতে থাকবে। তার ওপর বৈধ পথে ভারত থেকে এবার গরু আমদানির উপায় এক প্রকার রুদ্ধ। তবে অনৈতিক ও অবৈধ পথে সীমান্ত চোরাচালানে প্রতিবেশী দেশের গরু আসা কতখানি বন্ধ রাখা যাবে তা নিয়েও ইতোমধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে সরকার সীমিত আকারে পশুর হাট বসার নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা এবার অনলাইনেও গরু বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাটে, বাজারে, অনলাইনে কোরবানি পশুর ক্রয়-বিক্রয় যাই হোক না কেন পাশাপাশি আরও একটি সঙ্কটাপন্ন অবস্থা বিবেচনায় রাখা সঙ্গত। সেটা অবশ্যই ঢাকা শহর থেকে জেলা, উপজেলা, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের চলে যাওয়ার ঢল নামা। যা কোনভাবেই ঠেকানো আগেও সম্ভব হয়নি এবারও তা অসম্ভবের পর্যায়েই থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, সামরিক জোয়ান, র্যাব, আনসার সবাইকে এক সঙ্গে নিয়েও মানুষের যাতায়াতকে বন্ধ করা যায়নি কোরবানির ঈদেও তা পারার কোন যৌক্তিকতা নেই। এবার তো গণপরিবহনও সার্বিকভাবে খুলে দেয়া হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন বালাই আগেও ছিল না। এবারও একই দৃশ্যের ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।
আর পশুর হাট বসে বেচা-বিক্রি শুরু হয়ে গেলে জমজমাট হতেও সময় লাগবে না। অনলাইনে সবাই গরু কিনবেও না। মুষ্টিমেয় সচ্ছল সম্পদশালী দক্ষ ক্রেতা ছাড়া। ফলে পশুর হাটে ভিড় এড়িয়ে কিভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাবে তাও প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু যে বেচা-বিক্রি তা তো নয়- কোরবানীর পশু বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসা ছাড়াও তার রক্ষণাবেক্ষণ সেও এক নিরন্তর কর্মযোগ, যা এই করোনা দুর্যোগে কতখানি স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেবে তেমন সঙ্কটকেও আমলে নেয়া জরুরী। কোরবানির দিন পশু জবাই করে পুরো মাংস গোছানোর প্রক্রিয়াও তেমন সহজসাধ্য নয়। এখানে লোকবলও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়। যা বাসা বাড়ির সীমিত পরিসরে কতখানি স্বাস্থ্য বিধিকে মানতে পারবে সেটাও সংশ্লিষ্টদের ভাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব দিক সামলিয়ে কোরবানি দেয়াও এক প্রকার বিপন্ন অবস্থার শামিল। সারা বছর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এই দিনটির প্রতীক্ষায় থাকে। তার ওপর এবার হজের ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এখান থেকে কেউই হজ পালনের ব্রত নিয়ে সৌদি আরবে যেতে পারবে না। অবশ্য এমন নিয়ম সারা বিশ্বের সব ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য। সেখানেও পড়েছে এক ধরনের কঠোর প্রতিবন্ধকতা।
এ ছাড়া আমরা উৎসবপ্রিয় জাতি। আনন্দ, আয়োজন এবং আড়ম্বরতায় বিশেষ বিশেষ দিনগুলো পালন আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। যেখানে করোনাভাইরাস পর্বত প্রমাণ প্রাচীর তৈরি করে মানুষের মিলনকে ব্যবচ্ছেদ করেছে। গণজমায়েতের মতো সামাজিক আচার অনুষ্ঠানকেও নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিয়েছে। ঈদ-উল-ফিতরের নামাজ ও সাবধানী এবং সচেতন মানুষেরা ঘরে বসেই আদায় করেছেন। নতুন প্রক্রিয়ায় এই ধর্মীয় উৎসব আয়োজন পালন ভিন্ন ধারার সূচনাও করেছে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির মিলনের পথ যেমন সংহতি জোরদার করে আবার অন্য রকম ধারাও মানুষের জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হতেও সময় লাগে না। করোনা দুর্যোগ প্রচলিত অনেক ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে যে নবযুগের দ্বার উন্মোচন করল ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে তার সর্বশেষ গন্তব্য কোথায় সেটা ধারণা করাও মুশকিল। চলমান এবং পরিবর্তনশীল পৃথিবী সময়ের দাবিতে, প্রয়োজনের তাগিদে যে নতুন ধারাকে স্বাগত জানায় তাকেও অভ্যাসে পরিণত করতে কিছু সময় তো ব্যয় করতে হয়। নতুন আর পুরনো ধারার সংঘর্ষ কিছুকাল সময়ের পথিকদের বিব্রত করে। নবধারা আত্মস্থ করতে কালক্ষেপণ হয় এক সময় তা ধাতস্থও হয়ে যায়। আমরা এক পরিবর্তিত সময়ের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি যা সারা বিশ্বকে সমানভাবে অংশ নিতে হচ্ছে। যুগ এবং সমাজের পরিবর্তন পৃথিবীর সব জায়গায় একই সময়ে হয়নি। নতুন গতিপথে সমাজ সভ্যতা এগিয়ে চলা ঐতিহাসিক শর্ত। তেমন বৈশিষ্ট্যের ব্যত্যয় এতকাল হয়নি। করোনায় আমরা এক নতুন পৃথিবী প্রত্যক্ষ করছি। এর আগেও মহামারী, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং যুদ্ধের উন্মত্তায় সারা বিশ্ব উদ্বেলিত হয়েছে। সমাজের প্রকারভেদে এসব সাড়া জাগানো বিপর্যয়ের পার্থক্যও দৃশ্যমান হয়েছে। সমাজ প্রগতির ধারায় কেউবা এগিয়ে গেছে বাকিরা অপেক্ষাকৃত পেছনে থেকে পুনরায় নতুন আবেদনে শরিক হয়েছে। সেখানে যুগ, সময় এবং সমাজ আপন বৈশিষ্ট্যে এগিয়ে গেছে। কিন্তু করোনা সংক্রমণের এমন দুর্বিপাকে সারা পৃথিবীর যেন এক সঙ্গে সমানভাবে এই অনাকাক্সিক্ষত দুর্ভোগকে মোকাবেলা করে যাচ্ছে। ভেদাভেদের কোন বালাই নেই।
বিত্ত বৈভবের ন্যূনতম প্রভেদও দেখা যাচ্ছে না। অসচেতন, কম প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষেরাই বিপাকে পড়ছে সবচেয়ে বেশি। খেটে খাওয়া মানুষ লড়াই করে টিকে থাকার কারণে তাদের প্রতিরোধ শক্তি এত প্রবল যা এক সময় সম্পদ ঐশ্বর্যকেও হার মানায় একইভাবে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পেতে নিযামকের ভূমিকা পালন করে। করোনার সঙ্কটকালে তেমন অভিজ্ঞতাও আমাদের সাবধান করেছে পরিশ্রমের বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলনের অন্তরায় এই করোনা দুর্ভোগ নতুনভাবে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের অনেক বেশি সচেতনতা তৈরি করেছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চিকিৎসা ছাড়াও হাতের নাগালে যা কিছু পাওয়া যায় তার মধ্যেই রক্ষাকবচ লুকিয়ে থাকার নির্দেশনাও আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছে। অপ্রত্যাশিত এমন স্রোতে ভাসতে ভাসতে করে যে আমরা কূলকিনারা পাব তা ভাবাও যাচ্ছে না। তবে এই মুহূর্তে করণীয় স্বাস্থ্য সচেতনতাকে সর্বাধিক বিবেচনায় রাখা। সেটা শুধু যে প্রতিদিনের যাপিত জীবনে এমনটা নয়। উৎসবে, আয়োজনে গণজমায়েতের অনাবশ্যক ভিড়ের ব্যাপারেও সতর্ক-সাবধানতা অবলম্বন করা প্রত্যেকের জন্য অত্যন্ত জরুরী।
লেখক : সাংবাদিক