– ড. জেবউননেছা
দাদু ভাই বাংলাদেশের প্রথম আন্তজার্তিক মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। যে কারণে চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্র বিষয়ক গানের প্রতি আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। মনে পড়ছে শৈশবে চাচাত ভাই বোন মিলে একসাথে চলচ্চিত্র উপভোগ করার স্মৃতি। কিছু স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। বাবার দিনলিপিতে দেখা যায়, সাড়ে তিন বছর বয়সে মেজো চাচার পরিবারের সাথে প্রথম ‘দূরদেশ’ সিনেমা দেখেছিলাম নারায়ণগঞ্জের সিনেমা হলে, যে সিনেমা হলটি এখন নেই। সিনেমা হলে বসে উপভোগ করা ‘ভেঙ্গেছে পিঞ্জর’ গানটি হৃদয়ে এখনো অক্ষত হয়ে আছে। তখন তো শুধু সিনেমায় গান দেখতাম। কে গেয়েছেন, কে লিখেছেন, কে সুর করছেন এ বিষয়ে কখনও ভাবা হয়নি। মেজো চাচা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুবাদে আমাদের নারায়ণগঞ্জের বাড়ীতে এসেছেন প্রখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। নবম শ্রেণীতে প্রয়াত সুরকার আজাদ রহমানের সাথে পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়েছিল রাজধানী ঢাকার কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিসে।
তবে শৈশবে বাবার মিলন সংগীত কবিতায় এন্ড্রু কিশোর নামটি আমার কাছে ভীষণ পরিচিত ছিল। সংগীতটি ছিল এরকম, ‘ব্রজেন দাস মোদের বীর সাঁতারু / সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া যেন গান/ নিয়াজ মোর্শেদ সেরা দাবাড়ু / এন্ড্রু কিশোর জুড়ায় প্রাণ’। এখন প্রাণ জুড়াবে কীভাবে জানি না। শুধু জানি জীবনের অস্তাচলের সাথে মিশে গেছেন এন্ড্রু কিশোর। তার যাত্রায় সবাইকেই শামিল হতে হবে। কেউ আগে, কেউ পরে। কিন্তু এই শূন্যতা পূরণ হবে কী করে? এমন আর একজন দরদী কন্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর কোথায় পাবো? কে গাইবে দরদ দিয়ে গান? ২০১৯ সালের ৯ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশনে এন্ড্রু কিশোর মঞ্চে গান গাইলেন। বারে বারে খুব রাগ করছিলেন। কেন রাগ করছিলেন দর্শক সারির কেউ বুঝতে পারছিলাম না। তিনি হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, তাকে সহসাই চলে যেতে হবে। তাই হয়ত মায়া কাটিয়েছেন। কিছু কিছু মানুষ তো কখনো চলে যান না। তাদের সৃষ্টিকর্ম বেঁচে থাকে অনন্তকাল।
করোনার এই দুঃসময়ে গুণী ব্যক্তিদের চলে যাওয়া তাদের শ্রদ্ধার্ঘ দিতে না পারা এটা যে কত দুঃসহ তা কোন ভাষায় লিখে প্রকাশ করা যাবে না। যাদের কবিতা, গান, গল্প পড়তে পড়তে জীবনের এই প্রান্তে পৌঁছুলাম, তারা এক এক করে চলে যাচ্ছেন। একের পর এক মৃত্যু সংবাদ মনে হয় যেন বুকে বরফের পাহাড় জমেছে। শৈশব থেকে যার গান শুনে বড় হয়েছি, যার গানে হৃদয় মন ছুঁয়েছে, স্বপ্নে এঁকেছি নানা কল্পনা। যার কণ্ঠের সুধায় মন খারাপ করা মুহূর্ত নিমিষেই ভালো হয়ে যেতো। সে তো আর কেউ না। গায়ক এন্ড্রু কিশোর।
জীবনের এই প্রান্তে এসে শৈশব, কৈশোর দুরন্ত যৌবনের গানের সুরের কারিগরদের খুঁজে বেড়াই। খুজেঁ বেড়াই শিল্পীদের। খুঁজতে গিয়ে দেখি এক এক নক্ষত্র ঝরে যাচ্ছে। অমাবস্যার ঘনঘটা সংগীত ভুবনে। এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে গানগুলো জীবনের অংশ হয়ে আছে। সেগুলো কি ভুলে যাওয়া যায়?
এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে গাওয়া যে গানগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায় সেসব গানের কারিগরদের যদি দেখি, দেখা যায়, জীবনের গল্প আছে বাকী অল্প এই গান লিখেছেন মনিরুজ্জামান মনির, সুর দিয়েছেন আলম খান। হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, আলম খানের সুর দিয়েছেন। ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে গানটি লিখেছেন মনিরুজ্জামান মনির এবং সুর দিয়েছেন আলম খান, ভালো আছি ভালো থেকো গানটি লিখেছেন কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সুর দিয়েছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তুমি মোর জীবনের ভাবনা গানটি সুর দিয়েছেন এবং লিখেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আমার বুকের মধ্যখানে গানটি লিখেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গানটি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লিখেছেন এবং সুর করেছেন। আমার সারা দেহ খেও গো মাটি গানের সুরকার এবং গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। আমি চিরকাল প্রেমের কাঙ্গাল, গীতিকার শেখ সাদী খান, সুরকার মনিরুজ্জামান মনির। সবাইতো ভালোবাসা গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। অশ্রু দিয়ে লেখা এ গানটির গীতিকার ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সুর দিয়েছেন আলী হোসেন। কি যাদু করিলা গানটির গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির, সুরকার আলম খান। তুমি যেখানে আমি সেখানে গানটির গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির, সুরকার আলম খান। পড়ে না চোখের পলক গানটির গীতিকার এবং সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তুমি আমার জীবন গানটির গীতিকার এবং সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আমি একদিন তোমায় না দেখিলে গানটির সুরকার আলম খান। ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা গানটির সুরকার আলাউদ্দিন আলী। জীবন ফুরিয়ে যাবে ভালোবাসা ফুরাবে না জীবনে গানটির গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ওগো বিদেশিনী তোমার চেরী ফুল দাও গানটির গীতিকার আব্দুল হাই আল হাদী, সুরকার শেখ সাদী খান। কি জাদু করেছ বলো না গানটির গীতিকার মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, সুরকার আলী আকরাম শুভ। আমার হৃদয় একটা আয়না গানটির গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সাগরের মতোই গভীর গানটির গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই গানটির গীতিকার, সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আমি পাথরে ফুল ফুটাবো গানটির সুরকার আলম খান। তুমি চাঁদের জোছনা নও গানটির গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির, সুরকার আলম খান। ঘুমিয়ে থাকো ও সজনী গানটির গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। সবাইতো ভালোবাসা চায় গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। গানের এ তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ। যা একটি লেখায় লিখে শেষ করা যাবে না।
আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং ১৫ হাজার গানের প্লে ব্যাক শিল্পী এন্ড্রু কিশোর চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছেন গানের সুর তোলা কারিগর গীতিকার এবং সুরকাররা। একজন শিল্পী যখন চলে যান তখন তার সাথে চলে যায় একটি প্রজন্ম। সেই প্রজন্ম কখনো ফিরে না। কিন্তু তার রেশ ধরেই এগিয়ে যায় পরবর্তী প্রজন্ম। নিজের সুর, নিজের সংস্কৃতি অনুসরণ করেই এগিয়ে যায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি। আজকের এই দুর্দিনে আমাদের বড্ড বেশী দরদী শিল্পী, গীতিকার এবং সুরকার প্রয়োজন। যাদের মধ্যে থাকবে সুর, গান, তাল লয়ের মধ্যে সংগীত, সাহিত্য ।
সংস্কৃতি সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে। সুস্থ সংগীত চর্চা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কোন রকম দায়সারা গোছের শিল্পী, পাশ্চাত্য অনুসরনীয় সংগীত নয়। আমাদের পূর্বসুরীরা যেভাবে তাদের মেধা এবং জীবনকে সংস্কৃতির মধ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। তাদের জীবন কর্ম তুলে ধরা এখন সময়ের দাবী। তাদের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে। যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের জন্মদিন এবং মৃত্যুদিনে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের জীবন কর্ম এবং সংস্কৃতিতে তাদের অবদানের বিষয়টি তুলে ধরলে প্রজন্মের কাছে বিষয়টি খুব উৎসাহব্যাঞ্জক হবে। তাছাড়া সংগীত বিষয়ক পাঠক্রমে তাদের জীবন কর্ম তুলে ধরলে সংগীতাঙ্গনে যারা সংগীত নিয়ে চর্চা করেন, তাদের জন্য শিক্ষণীয় হবে।
লেখাটি যখন শেষ পর্যায়ে তখন মনে হচ্ছে শৈশবে ফিরে গিয়েছি, পরিবারের সকলের সাথে চলচ্চিত্র উপভোগ করছি। এন্ড্রু কিশোরের সুরে গান শুনছি। এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে গাওয়া গান আমাদের জীবনে স্মৃতির খোরাক হয়ে থাকবে। মানুষ বাঁচে স্মৃতি নিয়ে। সুস্থ চলচ্চিত্র, সুস্থ সংগীত চর্চা উপহার দেয় একটি সুস্থ প্রজন্ম। অনাগত প্রজন্ম একটি সুস্থ সুন্দর সংস্কৃতির চর্চার মাঝে বেড়ে উঠুক এটাই চাওয়া।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আর একজন এন্ড্রু কিশোরের জন্য। অপেক্ষা করছি এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে তুলে দেয়া গীতিকার এবং সুরকারদের জন্য। যারা ফিরবেন, লিখবেন এরপর কণ্ঠে গান তুলবেন এন্ড্রু কিশোর। এন্ড্রু কিশোররা কখনো মৃত্যুবরণ করেন না। তারা বেঁচে থাকেন হাজারো মানুষের স্মৃতির মনিকোঠায়। মনীষী বলেছেন, ‘জীবনের সকল সময়ই মধুর সংগীত দোল দেয় না, সময় বিশেষে দুঃখ বিদ্রোহ এবং উন্মাদনা সৃষ্টিকারী সংগীতের প্রয়োজন অনুভূত হয়।’ সেই উন্মাদনা সৃষ্টির জন্যই সুস্থ ধারায় সংগীত চর্চা এখন সময়ের দাবী। তবে এখনো এমন অনেকে আছেন যাদের ধ্যান জ্ঞান সাধনা শুধুই সংগীত। তাদের ও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া প্রয়োজন। তাদের মাঝে থাকা প্রতিভা বিকাশের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। খুজেঁ ফিরি দরদী কন্ঠশিল্পী, গীতিকার এবং সুরকার। যাদের সংগীতের সুরে নিঃসঙ্গতা ঘুঁচবে।