>>নাজমুল হক লাকি
শুভ জন্মদিন সঙ্গীত শিল্পী নাসির।
নদীর ঢেউ এর পরে ঢেউ এসে ভাঙেরে দু’কূল/মনের দুকূল ভাঙলো তবু ভাঙলো না তার ভুল।’ ময়না ও ময়নারে আর পরাণে সয় না রে/কতদিন হয় দেখিনা তোরে।’ বন্যেরা বনে রয় তুমি এ বুকে/তুমি সুখী হবে আমারই সুখে/তোমার জন্ম শুধু আমারই জন্য/চিরন্তন এ কথা সত্য রবে। কিংবা ভুল করে ভালবেসে যাই শুধু জ¦লে/এ জ¦ালায় বুঝেছি গো প্রেম কারে বলে/হায় প্রেম ও ভাঙচুর প্রেম।’ সঙ্গীত শিল্পী নাসিরের এসব গান শুনে আমাদের প্রজন্ম উন্মাতাল হয়েছে, প্রেমে পড়া শিখেছে। প্রেমের পবিত্রতা অনুভব করতে পেরেছে। প্রিয়জনের বিরহের দহন যখন দুচোখে শ্রাবণধারা হয়ে নামতো, তখন নাসিরের গানই আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত দূরের কোন স্বপ্নলোকে।
নাসিরের ছেলেবেলা কেটেছে শান্ত-¯িœগ্ধ উদার আকাশের কোলঘেঁষা রূপসা নদীর পাড়ে, খুলনা শহরে। এখানকার নদী-প্রান্তর, মাঠ পেরোনো সবুজ শৈশব তাঁকে গভীরভাবে টেনেছিল সুরের মোহময় ভুবনে। খুলনার খাল-বিল-নদী, রাতের তারায়, হলুদ সরষে ক্ষেতে, ভোরের শিশির ভেজা ঘাসের ফুলে জড়িয়ে আছে দেশ বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী নাসিরের রঙিন শৈশব। বৃষ্টিতে ভেজা রজনীগন্ধার মতই তিনি পরিচ্ছন্ন, মিষ্টি সৌরভ ছড়িয়েছেন বাংলা গানের সুরে সুরে। তাঁর মোহময় সুরে মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-ব্যথায় ভেসেছেন। মিলন-বিরহের অপার সীমানায় সমাধান খুঁজেছেন।

বাংলা গানের জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম মোঃ জামাল উদ্দিন নাসের। ডাক নাম নাসির। সঙ্গীত জগতে যাত্রা শুরু হয়েছিলো ইভস্ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হিসেবে। ইভস্ ব্যান্ডের টীম লিডার ছিলেন তোজো। দক্ষ ড্রামার শফিক তোজো। মাঝে মাঝে মঞ্চে গানও গাইতেন। পরে দেশব্যাপি বিখ্যাত হয়েছিলেন ড্রামার হিসেবেই। প্রধান ভোকালিস্ট ছিলেন সাব্বির। লিড গীটারে বিষু, কী-বোর্ডে ছিলেন রানা, বেজ গীটারে মিজান। এরপরে গিটারিস্ট ছিলেন সঞ্জয় বাড়ই। তাঁর গিটারের প্রতিটি টোকা ছড়িয়ে পড়তো ইন্দ্রজাল হয়ে। ভোকালিস্ট সাব্বির আমেরিকা চলে যাওয়াতে দেখা দিল শূণ্যতা। টীম লিডার তোজো মনে মনে ঠিক করলেন নাসিরকে। নাসির রিদম গীটারেও ছিলেন দারুণ পটু। কন্ঠে সুরও ছিল। টীম লিডার তোজো বলেেলন, ‘তোমার কন্ঠ খুব ভাল। তোমাকে দিয়েই হবে। প্র্যাকটিস প্যাডে চলে আসো। অডিশন দাও।’ অডিশন দিলেন নাসির। সিলেক্ট হয়ে গেলেন। শুরু হলো ইভস্ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হিসেবে শিল্পী নাসিরের নতুন এক অভিযাত্রা।
১৯৮৮ সাল। বন্যার্তদের সাহাযার্থে খুলনার ব্যান্ড শিল্পীরা আয়োজন করলো বিশাল কনসার্ট। খুলনার স্বনামধন্য ব্যান্ডের শিল্পীরা অংশগ্রহণ করছেন। দি ব্লুজ, ডিফারেন্ট টাচ, অবসকিউর, অরবিট, সিম্ফনি-এসব বিখ্যাত ব্যান্ডের শিল্পী প্রিন্স মাহমুদ, পলাশ, মেজবাহ, মনি জামানসহ অংশগ্রহণ করছেন আরও অনেকে। এর মধ্যে সঙ্গীত পরিবেশন করলেন ইভ্স ব্যান্ডের তরুণ ভোকালিস্ট নাসির। এত বড় কনসার্টে প্রথম গাইলেন তিনি। সেদিনই খুলনার সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ বুঝে গিয়েছিলেন-সঙ্গীতাকাশে জন্ম হতে যাচ্ছে আরও এক নতুন তারকার। সঙ্গীত ভুবনে সেই যে পা রাখলেন-এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ইভ্স ব্যান্ডের পাট চুকিয়ে ২০০৪ সালে চোখে সুরের স্বপ্ন নিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। শুরু হলো স্ট্রাগল। নতুন নতুন পরিকল্পনা করছেন। পরিশ্রম করছেন দিন-রাত। ভয়াবহ এ কষ্ট যেন অথৈ সমুদ্র! কোন কূল-কিনারা নাই! তবু থেমে যান নি নাসির। লক্ষ্যে থেকেছেন অবিচল। মনোবল হারাননি এক মুহূর্তের জন্যও। সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে! অবশেষে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলেন জানে আলমের দোয়েল প্রডাকশন্সের মাধ্যমে। দোয়েল প্রডাকশন্সের প্রথম অ্যালবামটি হতোদ্যম করে দিল, কিন্ত দ্বিতীয় অ্যালবাম সুপার-ডুপার হিট। নাসিরের প্রেমের আগুন জ¦ালাইয়া… চন্দ্রমুখী অ্যালবামের গানটি তখন মানুষের মুখে মুখে। সঙ্গীত শিল্পী নাসিরের এত দিনের স্বপ্ন, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা সাফল্যের সোনালী বন্দরে এসে নোঙ্গর করলো। সঙ্গীতা, সাউন্ডটেক-এর মত বড় বড় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলো নাসিরের ডেট পাওয়ার প্রত্যাশায়।
সঙ্গীতা থেকে প্রকাশিত অ্যালবামের গান নদীর ঢেউ এর পরে ঢেউ এসে ভাঙেরে দু’কূল…গানটি রাতারাতি তাঁকে তারকা খ্যাতি এনে দিল। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আধুনিক, ব্যান্ড এবং ফোক সঙ্গীত-এই তিনটি বিভাগেই তিনি অডিশনে পাশ করা শিল্পী। একজন শিল্পীর জন্য যা অকল্পনীয়। তালিম নিয়েছেন ক্ল্যাসিকালেও। প্রতিটি গানের কথা ও সুরের ওপর নাসিরের কণ্ঠের যে প্রভাব, তা যে কাউকে সহজেই মুগ্ধ করে। সুর ও সংগীতায়োজনের নান্দনিক ও বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনে তিনি হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি। তাঁর সুরেলা কন্ঠের গান আশি ও নব্বই দশকে তরুণ প্রজন্মের মুখে মুখে ফিরেছে। তাঁর অসংখ্য গান কালের সীমানা ডিঙিয়ে এখনো সমান জনপ্রিয়।
সবার প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী নাসির অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে চিরদিন বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের অগণিত ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ে। আজকের এই শুভ জন্মদিনে এ প্রত্যাশা সঙ্গীতপ্রেমীদের। খুলনার অসংখ্য মানুষের।
(আংশিক তথ্য ও ইভস্ ব্যান্ডের ভাঙচুর প্রেম’ অ্যালবামের কভারটি প্রিয়ভাজন শুভ’র ফেইসবুক পেজ মিউজিক বক্স থেকে নেয়া। শুভকে ধন্যবাদ।)