আসামি না হয়েও জেল খাটছেন খুলনার সালাম ঢালী : এসআই সঞ্জিতের কারসাজি

2
Spread the love

স্টাফ রিপোর্টার

‘নামে নামে যমে টানে’ বলে যে প্রবাদটি প্রচলিত রয়েছে তা আবারও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে খুলনায়। সাজাপ্রাপ্ত পলাতক এক আসামির সঙ্গে নামে কিছুটা মিল থাকায় এখন জেল খাটতে হচ্ছে খুলনার সালাম ঢালীকে।

অভিযোগ রয়েছে, আসামির নাম, বাবার নাম ও ঠিকানার একাংশ নামে মিল থাকায় নিরাপরাধ  মো. সালাম ঢালী (৩৮) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার প্রকৃত আসামির নাম মো. আব্দুস সালাম। মূল আসামিকে বাঁচাতে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভুল ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

অনুসন্ধানীতে জানা যায়, চলতি বছরের ১১মার্চ রাত ১২টায় নগরীর সোনাডাঙ্গা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জিত কুমার ম-ল সদর থানা এলাকার ৬০/১৮, শের-এ-বাংলা রোডের বাসিন্দা সালাম ঢালীকে গ্রেফতার করেন।  মো. সালাম ঢালীর পিতার নাম মফিজ উদ্দিন ঢালী। সালাম ঢালী এখন কারাগারে রয়েছেন। প্রায় চার মাস ধরে নিরাপরাধ মুদি দোকানি সালাম ঢালী বাগেরহাটের কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। অন্যদিকে প্রকৃত অপরাধী  মো. আব্দুস সালাম সোনাডাঙ্গা থানাধীন শেখপাড়া মেইন রোডের মৃত. শফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি এখন পলাতক রয়েছেন। মূলত নিজের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানায় একাংশ মিল থাকার সুযোগ নিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। তবে মামলার বিবরণে উল্লেখিত প্রকৃত আসামির নাম, পিতার নাম বা ঠিকানা  কোনোটাতেই পুরোপুরি মিল নেই।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০০৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর  কোস্টগার্ডের একটি টহল দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাত ৩টার দিকে মোংলা থানাধীন  ফেরিঘাট সংলগ্ন বাসস্টান্ডে একটি মিনি ট্রাক (চ-মেট্রো ড-১১-০২০৭) তল্লাশি চালিয়ে কিছু ইলেট্রনিক্স দ্রব্য জব্দ করে। যা মোংলা বন্দরে অবস্থানরত বাণিজ্যিক জাহাজ থেকে অবৈধভাবে সংগ্রহ করে ট্রাকযোগে খুলনায় পাচার করা হচ্ছিল। ট্রাকসহ মোট পণ্যের মূল্য ৮ লাখ ৪১ হাজার ২৫০ টাকা। এ সময়  মো. আব্দুস সালামসহ তিন জনকে আটক করে মোংলা থানায় হস্তান্তর করে। পবর্তীতে তারা জামিনে কারাগার থেকে বের হন আব্দুস সালাম।  মোংলা থানার মামলা নং- ২ (০৩/০৯/২০০৫)। যার জি আর নং-১৪৫/০৫।

২০০৯ সালের ৩০ জুলাই বাগেরহাটের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট  মো. ইয়ারব  হোসেনের আদালতে  মো. আব্দুস সালাম  দোষী প্রমাণিত হয়। এতে বিচারক তাকে দুই বছরের সশ্রম কারাদ- দেন। একইসঙ্গে আব্দুস সালাম পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১১ মার্চ এই অপরাধের মূল আসামিকে বাদ দিয়ে নিরাপরাধ সালাম ঢালীকে গ্রেফতার করে সোনাডাঙ্গা থানার সঞ্জিত কুমার ম-ল। এখন নিরাপরাধ সালাম ঢালী অপরাধী আব্দুস সালামের সাজায় জেল খাটছেন।

নিরাপরাধ সালাম ঢালীর স্ত্রী শারমিন বলেন, আমাদের বাসা গল্লামারী কাশেম সড়কের তিন নম্বর গলিতে। ১১ মার্চ রাত ১২টার দিকে সোনাডাঙ্গা থানার এসআই সঞ্জিত কুমার ম-ল আমার স্বামীকে ডাকেন। আমরা বলি আপনারা কারা? এত রাতে  কেন? আপনাদের পরিচয়?’ বাইরে  থেকে পরিচয় না দিয়েই বলছে, সালাম দরজা  খোলো। লিভারে সমস্যায় অসুস্থ সালাম প্রথমে দরজা  খোলে না। পরে অজানা আশঙ্কা নিয়ে আমরা স্বামী দরজা খুলে  দেন। সামনে দাঁড়ানো পুলিশ। আমরা পুলিশের  লোক। সোনাডাঙ্গা থানা থেকে এসেছি। আমার স্বামী জানতে চায়  কোনো সমস্যা নাকি? পুলিশ বলে আপনাকে থানায়  যেতে হবে একটা মামলা আছে।  সেই  লোক আপনি কিনা তা যাচাই করতে থানায়  যেতে হবে। আপনি আসামি না হলে আবার গাড়িতে বাসায়  পৌঁছে  দেওয়া হবে। এ বলে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। পরে থানা  থেকে আমার স্বামী আমাকে ফোন দেয় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু আমি  তো  কোনোদিন এ মামলার বিষয়ে কিছু জানিও না। তবে আমার স্বামী ও মূল আসামি আব্দুস সালামকে চিনি। পরের দিন তাকে বাগেরহাট কারাগারে পাঠানো হয়। আমরা থানায় গিয়ে কাগজপত্র উঠিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারি ১৫ বছর আগের মোংলার একটি মামলায় আমার স্বামীকে আটক করা হয়েছে। আমার স্বামীর জাতীয় পরিচয়পত্রে মো. সালাম ঢালী নাম রয়েছে। আমার একটি বিবাহিত  মেয়ে আছে। আমার স্বামী ভীষণ অসুস্থ। তিনি নিরাপরাধ। বিনা অপরাধে পুলিশ তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আমি তার মুক্তি ও মামলা  থেকে নিষ্পত্তি চাচ্ছি।

শারমিন বলেন, আমার স্বামীর ভোটার আইডি কার্ডের হিসাব মতে এখন বয়স ৫৭ বছর। কিন্তু মূল আসামি আব্দুস সালামের জায়গায় আমার স্বামীকে আসামির কাগজে বয়স  লেখা আছে ৩৮ বছর। আমার অভিযোগ পুলিশ  যেহেতু বাপের নামের জায়গায় কাটাকাটি করেছে তাতে  বোঝা যাচ্ছে ইচ্ছা করে করেছে। আসল আসামির কাছ  থেকে টাকার বিনিময়ে এ কাজ করেছে। মূল আসামি আব্দুস সালাম বর্তমানে ছাচিবুনিয়া থাকেন।

সোনাডাঙ্গা মডেল থানার এসআই সঞ্জিত কুমার ম-ল বলেন, তাকে যখন ধরে আনা হয়েছিল তার নাম, পিতার নাম, ঠিকানা মিলানোর পরই তাকে  কোর্টে চালান করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা ছিলো। সেও তা স্বীকার করেছে। আমাদের  রেজিস্টারেই  লেখা আছে আব্দুস সালাম পিতা মৃত মফিজ উদ্দিন। ওনাকে যখন গ্রেফতার করা হলো কখনো তিনি বলেননি আমি আব্দুস সালাম না সালাম ঢালী। সব ইনফরমেশন মিলে যাওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি ওসি ও এসি স্যারের কাছে নিয়ে  গেলে তারাও কথা বলে সবমিলিয়ে নিয়েছিলেন। একটা  লোক যাতে অযথা হয়রানি না হয় আমরা তার জন্য চেষ্টা করেছি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ বলেন, প্রকৃত অপরাধী  মো. আব্দুস সালামের পিতার নাম মৃত শফিজ উদ্দিন।  জেলা খাটছেন সালাম ঢালী, যার পিতার নাম মফিজ উদ্দিন ঢালী। নাম ও পিতার নাম ঠিকানা  দেখে  যে আসামিকে  গ্রেফতার করা হয়েছে তিনি এ মামলার আসামি নন। পুলিশকে নিশ্চিত হয়ে আসামিকে  গ্রেফতার করা উচিত ছিলো। আর এ মামলায় ওয়ারেন্টের কপিতে পিতার নাম শফিজের শ কেটে দিয়ে ম বানানো হয়েছে। মূল আসামি আগেই ঘটনার সময় ২০০৫ সালে একবার  গ্রেফতার হয়েছে। রিমান্ড ও জেল  খেটেছেন। মূল আসামির সঙ্গে  গ্রেফতার হওয়া  লোকের  কোনো মিল  নেই। মূল আসামিকে বাঁচানোর জন্যই এটা করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মামলার এজাহার, চার্জশিট, আসামির চালানসহ রিমান্ড আবেদনে মূল আসামি শফিজ উদ্দিনের  ছেলে  মো. আব্দুস সালাম, সাং  শেখপাড়া  মেইন  রোড, খুলনা। কিন্তু যাকে বাগেরহাটের সংশ্লিষ্ট মামলায় এখন আসামি হিসেবে চালান  দেওয়া হয়েছে তার নাম  মো. সালাম ঢালী পিং মফিজ উদ্দিন ঢালী সাং- শেরে বাংলা  রোড, খুলনা। অর্থাৎ সালাম ঢালী এই মামলার আসামি নন, তিনি উদ্দেশ্যমূলক বা ভুল গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন। এটি একটি চরম অন্যায় এবং সাংবিধানিক অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। পুলিশ অফিসারের উচিত সংশ্লিষ্ট বাগেরহাটের মামলার নথি যাচাই করে অবিলম্বে তাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করা এবং প্রকৃত আসামিকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।