করোনাকালে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার

14
Spread the love

-সাদিয়া আফরিন

যে কোন রোগের প্রাদুর্ভাবই ব্যক্তি, সমাজ এবং কাঠামোর উপর নানাবিধ প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য’র উপর কভিড-১৯ বা করোনা রোগের প্রভাব বিষয়ক উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য এখনও আমাদের হাতে নেই। তবে আমরা ধরে নিতে পারি যে করোনাকালে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেভাবে ‘ব্যাহত’ হচ্ছে নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যও এর বাইরে নয়।

নববিবাহিত, গর্ভবতী অথবা সদ্যপ্রসূত মায়েদের মধ্যে যাদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির চাহিদা রয়েছে, প্রসবপূর্ব ও প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন রয়েছে তাঁরা কভিড-১৯ প্রভাবিত হতে পারেন। বাংলাদেশের হাজারো নারী ও বিবাহিত কিশোরীরা দেশের ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতেই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক নানাবিধ সংকটের মধ্যে বেঁচে থাকে, বিশেষ করে যারা শহরের বস্তি এলাকা ও গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। তাছাড়া যেসমস্ত গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের পরিস্থিতি কি হতে পারে তা এখন পর্যন্ত অনুমাননির্ভর।

বলা বাহুল্য যে কভিড-১৯’র মত রোগের আকস্মিক আবির্ভাব বাংলাদেশের নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য’র ক্ষেত্রে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা ও সংকটের মুখোমুখি করেছে। কভিড-১৯ এর মত জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতিহীন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে এবং তার নজির ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে। সুতরাং করোনা মহামারীর মত নতুন একটি সামাজিক অভিজ্ঞতা অর্থাৎ কোয়ারেন্টাইন, সামাজিক দূরত্ব, গণপরিবহন ব্যবহার ও চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রস্তুতিহীনতা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব প্রভৃতি নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর বিস্তৃত পরিসরে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। 

নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থের্য ক্ষেত্রে কভিড-১৯ কতটা প্রভাব ফেলেছে তা এই মুহূর্তে বিশদ জানা সম্ভব না হলেও শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য রোগ যেমন, মার্স এবং সার্সের  ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে এই রোগগুলো গর্ভাবস্থায় খারাপ পরিণতি বয়ে আনে, যেমন- গর্ভনষ্ট হয়ে যাওয়া, অকাল গর্ভপাত, ভ্রুন বেড়ে না উঠা, এমনকি প্রসূতির মৃত্যুও ঘটতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যাতে করে বলা যায় যে গর্ভবতী মা’দের কভিড-১৯ এর ঝুঁকি সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি যেমনটা দেখা গিয়েছিল জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে। এটি গর্ভাবস্থার জটিলতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভ্রূণের অস্বাভাবিক ছোট মাথা এবং অপরিপক্ক ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট পরিলক্ষিত হয়েছিল।

গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন রকমের হরমোন নিঃসরণ হওয়ার ফলে নারীদের শারিরীক অবস্থা পরিবর্তিত হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং পুরো শরীর ভীষণরকম নাজুক অবস্থায় থাকে। ফলে ধারণা করা যায় যে, গর্ভবতী নারীরা করোনায় আক্রান্ত হলে এটি তাদের ক্ষেত্রেও ক্ষতির কারণ হতে পারে। ফলে গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত গর্ভকালীন সেবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গর্ভাবস্থার মত আরেকটি জরুরি বিষয় হলো সদ্যপ্রসূত মায়েদের প্রসবোত্তর সেবা এবং ব্রেস্টফিডিং কাউন্সেলিং। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কতজন মায়ের পক্ষে এইসমস্ত সেবা গ্রহণের সুযোগ এসেছে সে-সম্পর্কিত তথ্য এখনও আমাদের কাছে নেই। তবে অনুমান করা কঠিন নয় যে কোয়ারেন্টাইন, সামাজিক দূরত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার কভিড-১৯ সৃষ্ট চাপের ফলে গর্ভকালীন সেবা নিতে না পারা, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা (প্রেশার ও ডায়াবেটিস চেক আপ) করতে না পারা, জরুরী ওষুধপত্র সংগ্রহ ও গ্রহণ করতে না পারা, কভিড-১৯ কে ঘিরে সামাজিক হেনস্থা ও অসমতা প্রভৃতি গর্ভাবস্থা ও প্রসবত্তোরকালে নারী ও নবজাতকের স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে মারাত্মক জটিল করে তুলেছে। 

কভিড-১৯ নারীর জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনাও ব্যাহত করতে পারে। একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ করা। বিভিন্ন বয়সী নারীদের চাহিদা ও প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে কার জন্য কোন ধরণের পদ্ধতি প্রয়োজন, যেমন- সদ্যবিবাহিত কিশোরীদের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী পদ্ধতি অধিক কার্যকর, কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় যে এই দলভুক্তদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা খুবই সীমিত থাকে।

এদের অনেকেরই হয়তো যে কোন পদ্ধতি গ্রহণের পূর্বে একজন স্বাস্থ্যকর্মী অথবা চিকিৎসকের কাছ থেকে বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে, যেমন- কি কি ধরণের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি রয়েছে। কোন কোন পদ্ধতি তাদের জন্য মানানসই। এসমস্ত পদ্ধতি কোথায় পাওয়া যায়। অন্যদিকে কিছু নারীদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। অনেকেই হয়তো কোন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন কিন্তু পদ্ধতিটি তাদের শরীরে মানাচ্ছে না। কোন পদ্ধতিটি তাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সে বিষয়ে জানেন না। অনেকেই সম্প্রতি বাচ্চা প্রসব করেছেন অথবা যাদের এক বা একাধিক সন্তান বর্তমান তারাই বা কি ধরণের পদ্ধতি গ্রহন করবেন। অনেকেই হয়তো কোন একটি দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতির মধ্যে রয়েছেন কিন্তু সেটি শরীরে অসুবিধার সৃষ্টি করছে সে বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে আলোচনা করতে চান অথবা খুলে ফেলতে চান। কেউ কেউ স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহন করতে চাইতে পারেন। কারো কারো মেন্সট্রুয়াল রেগুলেশন এমনকি গর্ভপাত করার প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্বের বাধ্যবাধকতায় উপরের যে কোন সমস্যাই প্রকট হয়ে উঠতে পারে অর্থাৎ নারীরা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করে ফেলতে পারেন এবং এর দরুন অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মুখোমুখী হতে পারেন এইসব সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে।    

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউনিসেফের একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী ঘোষণার পর থেকে পরবর্তী নয়মাসের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তত ২৪ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করবে যা শুধু ব্যক্তি ও পরিবারের উপরই না দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপরও মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে। শিশুর এই অস্বাভাবিক জন্মহার বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রের উপর অত্যন্ত সুদূর প্রসারী প্রাভাব বিস্তার করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ইউনিসেফ বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে কিছু প্রয়োজনীয় বার্তা প্রদান করে। যেমন- যেভাবেই হোক গর্ভবতী মায়েদেরকে গর্ভকালীন সেবা, দক্ষ হাতে প্রসবসেবা, প্রসবোত্তর সেবা এবং কভিড-১৯ সম্পর্কিত সেবা পেতে সহায়তা করতে হবে।

স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোষাক নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদেরকে কভিড-১৯ টেষ্ট ও ভ্যাক্সিনেশনের (যখনই পাওয়া যাবে) ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে যাতে করে তারা গর্ভবতী মা ও নবজাতক শিশুদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে পারে।শিশুর জন্মের সময় এবং পরবর্তীকালে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী ও নতুন মাদের কাছে পৌঁছাতে হবে এবং যে সমস্ত মায়েরা রিমোট এলাকায় বাস করে তাদেরকে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে অথবা টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যে সমস্ত যায়গায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে আছে সেসমস্ত যায়গায় স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিষ্কার বার্থ কিটের প্রশিক্ষণ, সুরক্ষা ও যোগান দিতে হবে যাতে করে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্তান প্রসব করাতে পারে। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য জীবন রক্ষাকারী সেবা ও যোগানের জন্য সম্পদের বরাদ্দ রাখতে হবে।

অন্যদিকে নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য মোকাবিলায় ইউএনএফপিএ প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশনা দিয়েছে- শ্বাসতন্ত্রের রোগে ভুগছেন এমন গর্ভবতী মা’দের সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। গর্ভকালীন, প্রসবোত্তর, নবজাতক এবং মায়েদের ইউনিটগুলোকে অবশ্যই কভিড-১৯ কেসগুলো থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মিদের, বিশেষ করে মিডওয়াইফ, নার্স, অবস্ট্রেক্টিশিয়ান, এনেস্থিয়োলজিস্ট সবাইকে  সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে যাতে করে তারা আক্রান্ত হতে না পারে এবং যদি তারা সরাসরি কভিড-১৯ রোগীর পরিচর্যার কাজে যুক্ত থাকেন তাহলে তাদেরকে অবশ্যই ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোষাকের যোগান দিতে হবে। কভিড-১৯ মোকাবিলায় অবশ্যই বয়স, লিঙ্গ, লিঙ্গিয় সম্পর্ক এবং গর্ভাবস্থার মত বিষয়গুলোকে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে এবং নাজুক জনগোষ্টীর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। মাতৃস্বাস্থ্য এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রবাহ ঠিক রাখার জন্যও ইউএনএফপিএ কিছু সুপারিশ প্রদান করেছে। যেমন কভিড-১৯ স্ট্যাটাস যাই হোক কন্যাশিশু ও নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক পছন্দ এবং অধিকারকে সম্মান জানাতে হবে।

দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসংস্থা কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে গর্ভবতী ও প্রসূতি মা এবং সামনের সারির স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের স্বাস্থ্যকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। কভিড-১৯’র দ্বারা নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য যাতে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত না হয়, গর্ভবতী মায়েরা যাতে নিরাপদে বাচ্চা প্রসব করতে পারে, নিয়মিতভাবে গর্ভ ও প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে, নবজাতককে বুকের দুধ পান করাতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে বলা হচ্ছে। ফলপ্রসূভাবে কভিড-১৯ মোকাবিলা করার জন্য একটি কর্মক্ষম এবং সক্ষম স্বাস্থ্যব্যবস্থা দরকার। কিন্তু যে সমস্ত দেশের সামর্থ্য কম বা কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের পক্ষে এই সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন করা আসলে কতখানি সম্ভব?

করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অন্যান্য খাতের চাইতে জরুরি মা এবং প্রজনন সেবা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে প্রসবকালে নারী এবং নবজাতকের আইসোলেশনের রাখার মত এবং যতœ পাওয়ার মত সুবিধাদি কম থাকার কারণে। সিজারিয়ান অপারেশন বা এবোরশনের ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী কৌশলগুলো বিলম্বিত হতে পারে কর্মীর স্বল্পতা এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাবে, যেমনঃ অপারেশন থিয়েটার বা সাধারণ ওয়ার্ড। বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে পাবলিক হাসপাতালগুলোতে নারী রোগীদের সেরে উঠার জন্য ওয়ার্ডে থাকতে হয় এবং খাবার ও যতেœর জন্য আত্মীয়দের উপর নির্ভর করতে হয়। সাধারণ ওয়ার্ডে নারীদের জন্য আইসোলেশন তৈরি করা এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা কঠিন। তাছাড়া গর্ভকালীন, প্রসবোত্তর সেবা, ব্রেস্টফিডিং ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির কাউন্সেলিং অথবা অন্যান্য জরুরি প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার জন্য তাঁদের চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হয়, জনাকীর্ণ যায়গায় লোকজনকে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয় যা নারীদের কভিড-১৯-এ সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেই নয় কভিড-১৯ কেন্দ্রিক সামাজিক বিযুক্তির ধারণা শহরের জনাকীর্ণ বস্তিপাড়া কিংবা যে জায়গাগুলোতে অনেক লোকজন একঘরে ঠাসাঠাসি করে বসবাস করে সে-সমস্ত যায়গায় প্রয়োগ করার চিন্তা ইউটোপিয়া বৈ কিছু নয়।       

অন্যদিকে কভিড-১৯ এর কারণে ঘোষিত সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউনকালে যেসমস্ত নারীদের সন্তান প্রসবের ক্ষণ নির্ধারিত ছিলো তাঁদের সকলেই নির্বিঘ্নে সন্তান প্রসবে সক্ষম হয়েছেন এমনটা ধারণা করা দুরূহ। কেননা ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতেই বিভিন্ন ধরনের প্রসবকালীন জটিলতা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। আমরা জানিনা মহামারীর সময়ে কতজন মা এই ধরনের জটিলতায় সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে ইউনিসেফের সুপারিশ স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়িবাড়ি গিয়ে গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং প্রসবত্তোর সেবা প্রদান করা বাংলাদেশের মত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করা এক অলীক কল্পনা মাত্র।

যে কোন মহামারীর লিঙ্গীয় প্রভাবও উপেক্ষা করার মত নয়। নারীর লিঙ্গীয় ভূমিকা গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের অধিকতর কভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে কারণ পারিবারিক পরিসরে নারীরাই মূলত শিশু, কিশোর, বয়স্ক ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। ফলে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের যথাসম্ভব পারিবারিক কাজের ভার কমিয়ে দিয়ে পরিবারের অন্যান্য লোকজনের মধ্যে ভাগাভাগি করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের মত পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শে গৃহশ্রম বিভাজনের প্রেক্ষাপটে এটি কতটা সম্ভব? এরইমধ্যে বিভিন্ন উৎস থেকে দেখা গেছে যে মহামারি ঠেকাতে বাধ্যতামূলক সামাজিক বিযুক্তি বরং গৃহস্থালীর সহিংসতা বাড়াতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করছে। তাছাড়া কভিড-১৯ সংক্রমণের সাথে সামাজিক হেনস্থার  ভয়, আক্রান্ত গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের ‘একঘরে’ করে রাখা তাদেরকে আরও নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে সে-সম্পর্কেও আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারছি।   

কভিড-১৯ মহামারীর মাধ্যমে বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গীয় এবং সম্পদের অভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি হচ্ছে। আয়ের পথ বন্ধ হওয়া, দারিদ্র, ক্ষমতাহীন হওয়া, অসহিষ্ণুতা এই বিষয়গুলো মোটামুটিভাবে নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং এ-বিষয়ক অধিকারের ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। মানবাধিকার বিষয়ক নীতিমালা আমাদেরকে এব্যাপারে করণীয় কি তা ঠিক করতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে, মহামারি রেসপন্সের ক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও সমতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে; স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা, এবং মান নিশিচতকরণের মাধ্যমে; স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে। আমাদেরকে এসময় বৈশ্বিক উদাহরণ থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষা নিতে হবে যে কিভাবে বৈশ্বিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সমন্বিতভাবে এই সমস্যাকে মোকাবিলা করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সদিচ্ছা।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক