গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে পাটকলের ২৪৮৮৬ শ্রমিক

4
Spread the love

>> ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে শ্রমিকদের সম্পূর্ন টাকা এককালীন পরিশোধ করা হবে: সিটি মেয়র

>> পুঁজিপতিদের স্বার্থে জাতীয় সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ করছে: বাম জোট

বিশেষ প্রতিনিধি:


দেশের পাটকলগুলোতে অব্যাহত লোকসানের মুখে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। রোববার (২৮ জুন) এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এই ঘোষণা দেন।

পাটকলগুলোতে লোকসান হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা লোকসান নিয়ে পাটকল চালাতে পারি না। সরকার চিন্তা করেছে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে এই খাতকে এগিয়ে নিতে হবে। মন্ত্রী বলেন, বিজেএমসি’র ক্রমবর্ধমান লোকসানের কারণে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রক্রিয়ায় অবসায়নের মাধ্যমে মিলগুলোকে বর্তমান দেশিয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযাযী আধুনিকায়ন করা হবে। পাটমন্ত্রী বলেন, পাটকল শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন। তবে কবে সেই সুযোগ হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি মন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ৪০ বছর আমরা কোনো লাভ করতে পারিনি, সব সময় লোকসান হচ্ছে। সে কারণে সরকার চিন্তা করেছে কীভাবে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকর মাধ্যমে কারখানাগুলোকে আধুনিকায়ন করে এগিয়ে নিতে পারি। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের ক্ষতি না করে তাদের লাভবান করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। করোনার এই সময়য়ে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো- প্রশ্নে পাটমন্ত্রী বলেন, এই সিদ্ধান্ত ছয় মাস আগের। এই সময়ে তো তাদের টাকার প্রয়োজন হবে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেক হলো স্থায়ী শ্রমিককে মজুরি কমিশন অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ করে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। সংবাদ সম্মেলনে বস্ত্র ও পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, পাটকলগুলোতে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারী রয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের চাকরির অবসান করতে। পাশাপাশি অবসরে যাওয়া শ্রমিকরাও লাভবান হবে বলে জানান সচিব।
তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন শ্রমিকের প্রাপ্য সকল বকেয়া, বর্তমানে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিকের প্রাপ্য বকেয়া মজুরি, শ্রমিকদের পিএফ জমা, গ্রাচ্যুইটি এবং সেই সাথে গ্রাচ্যুইটির সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে অবসায়ন সুবিধা একসাথে শতভাগ পরিশোধ করা হবে। এজন্য সরকারি বাজেট হতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রদান করা হবে। পাট সচিব বলেন, রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলোতে ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন পাটকল শ্রমিক অবসরে গেছেন। অব্যাহত লোকসানের কারণে অর্থ সংকটে তাদের অবসর ভাতা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, এসব শ্রমিক গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের টাকা পাবে এবং তখন এসব শ্রমিক সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি করার সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

সচিব বলেন, করোনা মহামারি না হলে এ বছর লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতো। পাটখাতের যে সম্ভাবনা তা যদি ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে আগামী তিন-চার বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার অর্জন করা সম্ভব হবে। ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সময়যোপযোগী গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে এটাকে আরও উৎপাদনমুখী, কল্যাণকর ও জনবান্ধব করার পদক্ষেপ নিয়েছেন’, বলেন সচিব। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের বিরোধিতায় সারা দেশের ২৬টি পাটকলের শ্রমিকদের আন্দোলনের ঘোষণার মধ্যেই বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমিকদের অসবায়নের ঘোষণা দেন। এ নিয়ে খুলনায় পাটকল শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
র‌্যাব মহাপরিচালক খুলনা থেকে এই সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত ছিলেন। র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সরাসরি মন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছেন। এরপর তিনি সবার সঙ্গে সভা করবেন। খুলনায় র‌্যাব মহাপরিচালকের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ছাড়াও পাটকল শ্রমিক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।


ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে শ্রমিকদের সম্পূর্ন টাকা এককালীন পরিশোধ করা হবে:


খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সিটি মেয়র আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শে বেতন কাঠামো রক্ষা করে ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে শ্রমিকদের সম্পূর্ন টাকা এককালীন পরিশোধ করা হবে। কমবয়সী দক্ষ শ্রমিকদের নতুন মিলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কোন মধ্যস্বত্ত্বভোগীকে সুবিধা দেয়া হবেনা। শ্রমিকের টাকা বাকি রেখে মিল বন্ধ ঘোষণা হবে না। তিনি আরো বলেন, সাধারণ শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে অনেকে রাজনীতি করে বার বার মিল বন্ধ করে আন্দোলন করা হয়েছে। বন্ধ পিপলস্ জুট মিল নতুন ভাবে চালু করে ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেই মিল এবং শ্রমিকদের নিয়ে নোংরা রাজনীতি করে ১১ হাজার কোটি টাকা সরকারকে লোকসান গুনতে হয়েছে।

এ অবস্থায় কোন মিল চলতে পারে না। সেজন্যে প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনা খালিশপুরকে নতুন ভাবে শিল্পায়িত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সেভাবেই শিল্পনগরী খালিশপুরকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে পুরাতন মিল বন্ধ করে নতুন মিলের মাধ্যমে কমবয়সী দক্ষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্তে কেউ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলে তার বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শ্রমিকদের পাশে থাকতে হবে।
রবিবার বিকাল ৫টায় দলীয় কার্যালয়ে খালিশপুর, দৌলতপুর ও খানজাহান আলী থানার নেতৃবৃন্দকে নিয়ে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের বিশেষ জরুরি সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভায় বক্তব্য রাখেন, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা। মো. মুন্সি মাহবুব আলম সোহাগের পরিচালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, আওয়ামী লীগ নেতা মো. আশরাফুল ইসলাম, এ কে এম সানাউল্লাহ নান্নু, মনিরুল ইসলাম বাশার, প্যানেল মেয়র আমিনুল ইসলাম মুন্না, কাউন্সিলর খুরশীদ আহমেদ টোনা, কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনি, কাউন্সিলর মো. ডালিম হাওলাদার, প্যানেল মেয়র মেমরী সুফিয়া রহমান শুনু, কাউন্সিলর পারভীন আক্তার, কাউন্সিলর রহিমা আক্তার হেনা, মো. শেখ সাহাবুদ্দিন, মো. সেলিম আহমেদ, মো. ইমরুল ইসলাম, মো. শাহজাহান জোমাদ্দার, আব্দুস সাত্তার লিটন, জিয়াউল আলম খান খোকন, জিয়াউর রহমান জিয়া, হায়দার আলী মোল্লা, সরদার আলী আহমেদ, এস এম মনিরুজ্জামান মুকুল। এসময়ে উপস্থিত ছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতা বেগ লিয়াকত আলী, নুর ইসলাম বন্দ, শেখ শহিদুল ইসলাম, শেখ ইউনুস আলী, কাউন্সিলর শেখ মোশারাফ হোসেন, শেখ সৈয়দ আলী, উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন, মোজাম্মেল হক হাওলাদার, মাকসুদ আলম খাজা, স. ম. রেজওয়ান, কাউন্সিলর মো. সাইফুল ইসলাম, রনজিত কুমার ঘোষ, মো. সফিকুর রহমান পলাশ, এস এম আসাদুজ্জামান রাসেল, মো. শফিউল্লাহ, আসলাম আলী।


পুঁজিপতিদের স্বার্থে জাতীয় সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ করছে: বাম জোট:


রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধ করে পিপিপি বা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত বাতিল করা এবং ভুলনীতি-দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধ করে পাটশিল্পকে আধুনিকায়নের দাবীতে পূর্বঘোষিত কমসূচির অংশ হিসেবে বাম গণতান্ত্রিক জোট, খুলনা জেলা শাখার উদ্যোগে রবিবার সকাল সাড়ে ৯টায় আটরা শিল্প এলাকার ইষ্টার্ণ জুট মিলস্ গেটে প্রতিবাদী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সদস্য মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেনÑবামজোট খুলনা জেলা সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ নেতা জনার্দন দত্ত নাণ্টু, বাংলাদেশের কমিউনস্ট পার্টি (সিপিবি)’র কেন্দ্রীয় সদস্য এস এ রশীদ, খুলনা জেলা সাধারণ সম্পাদক এড. রুহুল আমিন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সদস্য গাজী নওশের আলী, টিইউসি খুলনা জেলা সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান মোল্লা, ইষ্টার্ণ জুট মিলস শ্রমিকনেতা আলাউদ্দিন, ইজদান আলী, মেহেদী হাসান বিল্লাল প্রমুখ।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, সরকার দেশের লুটেরা পুঁজিপতিদের স্বার্থে জাতীয় সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ করছে। স্বাধীনতার পর বিজেএমসি’র আয়ত্বাধীন ৮১টি মিল ছিল। বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে সরকার ’৮০ ও ’৯০ দশকে অধিকাংশ মিল বন্ধ করে। সর্বশেষ ২০০২ সালে বিশ্বখ্যাত আদমজী মিল বন্ধ করেছে। এতে পাট পণ্যের বাজার বাংলাদেশের হাত থেকে ভারতের হাতে চলে গেছে। এখন সরকারের কাছে মাত্র ২৫টি মিল চালু আছে। বর্তমানে পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাটপণ্যের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে। এ বর্ধিত বাজার মুনাফাবাজ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যই সরকার এসব পাটকল বন্ধ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দিতে চায়। এরজন্য দুর্নীতি ও লুটপাট করে এসব শিল্পকে সুপরিকল্পিতভাবে অলাভজনক করা হয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ-স্কপ এসব মিলের অব্যবস্থাপনা দূর করে আধুনিকীকরণ করার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা সরকারকে দিয়েছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। এ সব প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করতে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা লাগবে অথচ এ মিলগুলো বন্ধ করতে সরকারের ছয় হাজার কোটি লাগবে। করোনা মহামারী এ দুর্যোগে সরকার প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক, তাদের কয়েক লক্ষ পরিবার ও পাটচাষিসহ কোটি মানুষকে পথে বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। নেতৃবৃন্দ সরকারের এ স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক নাগরিকবৃন্দ, শ্রমিক-কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ডাক দেন। আগামী ২৯ জুন সকাল সাড়ে ৯টায় রাজঘাট শিল্পাঞ্চলে জেজেআই জুট মিলস্ গেটে এবং ৩০ জুন সকাল সাড়ে ৯টায় খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে প্লাটিনাম জুট মিলস গেটে সমাবেশ সফল করার আহ্বান জানান নেতৃবৃন্দ।