ঢাকা অফিস
দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল কবে থামবে? কবে নাগাদ সংক্রমণ ও মৃত্যুর পারদ সর্বোচ্চ চূড়ায় (পিক) উন্নীত হবে? একদিনে সর্বোচ্চ কত সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে, সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুই-বা হবে কতজনের? কবে মানুষ ফিরে পাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সুযোগÍ এমন নানা প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কেউ এসব বিষয়ে খোলাসা করে মন্তব্য করতে চাইছেন না। তবে কেউ কেউ বলছেন, এখন পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হিসাব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়নি। কেউ বলছেন, জুলাই মাসের শেষে হয়তো চূড়ায় পৌঁছাবে। আবার কেউ কেউ ‘এখনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর সর্বোচ্চ চুড়ায় রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন শুনিয়েছেন আশার বাণী। বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) বিকেলে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমেরিকা বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে এক লাফে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা প্রাণহানি ঘটবে না।’
তিনি বলেন, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একইভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। তার মতে, দেশে এখনই করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর চূড়ান্ত পর্যায়ে (পিক) রয়েছে। ‘নতুন করে খুব বেশি সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হবে, এমনটা মনে করছি না।’ তিনি আরও বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেমন ধীরে ধীরে বেড়েছে ঠিক তেমনি ধীরে ধীরে কমবে। একেবারে দ্রুত সংক্রমণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কবে নাগাদ কমে আসতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে আলমগীর হোসেন আশা প্রকাশ করে বলেন, জুলাই মাসের শেষের দিকে সংক্রমণের সংখ্যা কমে আসতে পারে। একই অভিমত ব্যক্ত করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার মতে, করোনার মূল প্রবাহ (পিক টাইম) তো আসবে এ মাসে (জুন) বা তার পরের মাসে (জুলাই)। যখন এটা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়বে। সেজন্য একটা সুস্থ স্বাস্থ্যব্যবস্থা দরকার।’
দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ৬০৭ জনে। অদৃশ্য এই ভাইরাসে মোট মারা গেছেন এক হাজার ৬২১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৩৯ জন।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেনও। তিনি বলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ইউরোপ-আমেরিকার মতো দ্রুত হচ্ছে না, তবে বন্যার পানি যেমন ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে বাড়িঘর তলিয়ে যায় ঠিক তেমন পরিস্থিতি বর্তমানে বিরাজ করছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে সেই অর্থে ‘পিক’ সময়টা বোঝা যাবে না। করোনার সংক্রমণ রোধে ঘনবসতিপূর্ণ ও অধিক সংক্রমিত এলাকাকে লাল, হলুদ ও সবুজ, এ তিনটি জোনে ভাগ করে জোনভিত্তিক লকডাউন শুরু হয়েছে।
‘সত্যিকার অর্থে কার্যকর লকডাউন করা হলে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার রোধ করা সম্ভব হবে।’ ‘বর্তমানে করোনা সংক্রমণ তুষের আগুনের মতো ঢিমেতালে জ্বলছে’ উল্লেখ করে মোশতাক হোসেন বলেন, ‘সঠিক পদ্ধতিতে সংক্রমণ রোধ করা না গেলে যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটে নির্দিষ্ট কোনো এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত বা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারেন। তবে সেই অবস্থা যেন না হয় সেটাই সবার কাম্য।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফায়েজ বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসায় পৃথক ইউনিট থাকে। আমাদের দেশে সেই অর্থে কোনো ইউনিট নেই। বর্তমানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে সংক্রামক ব্যাধি ইউনিট থাকার প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যাচ্ছে।’
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কোন পর্যায়ে রয়েছে, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের যেসব কর্মকর্তা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন- বিএমএ’র দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, শুরুর দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক শ্রেণির কর্মকর্তার একগুয়েমির কারণে দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত না করেও ‘সকল প্রস্তুতি রয়েছে’ বলে দাবি করেন। পরবর্তীতে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে দেখা যায়, হাসপাতালগুলোর তেমন প্রস্তুতি নেই।
‘তবে বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সংক্রমিত এলাকা কার্যকর লকডাউনের আওতায় আনা গেলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।’
গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহর থেকে ছড়ানো করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা চার লাখ ৮০ হাজারের বেশি। তবে ৫০ লাখ ৬০ হাজারের বেশি রোগী ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। একে একে আক্রান্ত হন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ। ইতোমধ্যে ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়েছে। মোট আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসক এক হাজার ২৬৮ জন, নার্স এক হাজার ১৯৯ এবং অন্যান্য সহযোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা এক হাজার ৬২৮ জন। এ ভাইরাসে ইতোমধ্যে ৪৭ জন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসক আক্রান্ত এবং তাদের মৃত্যুর বিষয়টি বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায়নি।