স্যালুট, বন্ধু কামাল লোহানী

8
Spread the love


-তুষার আবদুল্লাহ


এই প্রথম মনে হলো বন্ধু হারালাম। যখন তখন যার কাছে আবদার করা যায়, জেদ করা যায় কোনও কিছু আদায়ের জন্য। ব্যক্তিগত, পেশাগত কিংবা সাংগঠনিক কাজের অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে যার ছায়াতলে গিয়ে দাঁড়ানো যায়, তাকে তো বন্ধুই বলতে পারি? হুম, কামাল লোহানী আমার বন্ধু ছিলেন। খুব দেরি হয়েছে তার কাছে ভিড়তে। শূন্য ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষ দেখলে গা ছম ছম করতেই পারে। কাছে যেতে বুক কাঁপবেই। ওনাকে দূর থেকে দেখেছি মাঠে, ময়দানে। সফেদ পোশাকের মানুষটির মনটিও যে সফেদ সে কথা তার কাছের মানুষদের কাছ থেকে জানা। তার পেশাগত জীবনের দুঃসাহসিক ভূমিকা শুনে কেবল রোমাঞ্চিত হয়েছি। চারপাশের পোষ্য পেশাজীবীদের ভিড় দেখে যখন অবসাদের নিমজ্জনে ঠেলে নিতে চায়, তখন কামাল লোহানী দূরে বাতিঘর হয়ে জৌজ্বল্যমান। কখন কবে যে সেই আলোকরশ্মি কাছে টেনে নিয়েছিল।
প্রথম যেদিন কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, সেই দিন থেকে আজ অবধি একরকমই অনুভূতি তাকে নিয়েÍআমরা দুজন কি একই স্কুলে বা কলেজে পড়েছি? নাকি সাংবাদিকতায় সহচর দু’জন। যখন তখন ফোন করা। দেখা হলে হাসি ঠাট্টা, স্কুলের সহপাঠীর সঙ্গেও এতটা করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। আমার জীবন বন্ধু কাকলী প্রধান, ওনাকে বলতো কাকু। আমি ভাই। বন্ধুময় সম্পর্কের মাঝে তিনি সাংবাদিকতার পথিকৃতের আসনে বসে আছেন। সেখানে তিনি একা। সাংবাদিকতা পেশার সংকট এখানে। আমরা কেউ তাকে অনুসরণ করে, সেই সততা ও সাহসিকতার পথে হাঁটা শুরু করতে পারিনি।

কামাল লোহানী তার ৮৫তম জন্মদিনে আমাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেনÍ‘জনগণ বিচ্ছিন্ন হলে রাজনীতি যেমন করা যায় না, তেমনি অন্যান্য পেশার কাজও সঠিকভাবে করা যায় না। এটা আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। তার কারণটা হচ্ছে, রাজনীতি যে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সেটা তো আমরা সর্বক্ষণই প্রত্যক্ষ করছি। রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন যদি সঠিকভাবে করতে পারতাম তাহলে কিন্তু জনগণ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হতাম না।’ বন্ধু লোহানী ভাই বলতেনÍ‘আমরা যারা মানুষের জন্য কাজ করি, তাদেরকেও আমাদের বলতে হচ্ছে আজকাল যে, জনগণের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।’
তিনি যখন হাসপাতালে প্রথম দফায় ভর্তি ছিলেন। কেবিনের ছবি দেখে মনে হচ্ছিল তিনি তো আগের মতোই আছেন। হয়তো চোখটা জ্বালাচ্ছি বেশি। না হলে ভালোই আছেন, আনন্দে আছেন। শেষ দেখা হয়েছিল ধানমন্ডির একটি বই ক্যাফেতে। এসেছিলেন সপরিবারে প্রাতঃরাশ খেতে। আমরা গিয়েছিলাম কৈশোর তারুণ্যে বইয়ের বৈঠকে। দেখে ডাকলেন। শুনলেন শ্রেণিকক্ষের পাশে বই পড়া আন্দোলনের অগ্রগতি। তিনি নিজেও একবার একটি মেলায় হাজির হয়েছিলেন, আশীর্বাদ জানাতে। তার সঙ্গে প্রতিবারের দেখাতে, এবং চলে যাওয়ার দিনেও একটি প্রশ্নই করি নিজেকে, আমরা মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি কেন? সাধারণ মানুষের চিন্তা, তার লড়াইয়ের শক্তির ওপর ভরসা রাখতে পারছি না। অথচ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার আন্দোলনে আমরা জয়ী হয়েছিলাম মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখেই।
শুধু কি বাংলাদেশ? পৃথিবীর সকল সংকটে সম্মিলিত যে প্রতিবাদ, লড়াই এবং অধিকার ছিনিয়ে আনার ইতিহাস, তার কোনও কোনোটিই অর্জিত হয়নি, মানুষের ওপর আস্থা না রেখে। মানুষের ওপর আস্থা না রাখলে সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর যে অসুখ, মানসিক অবসাদ দেখা দেয়, তার উপসর্গগুলো বারবার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও একক হয়ে যাওয়া মানুষগুলো সেই উপসর্গ দেখার, উপলব্ধি করার বোধটিও হারিয়ে বসে আছে। কামাল লোহানী বলেছেন, জনগণের ওপর থেকে আমরা যদি আস্থা হারিয়ে ফেলি তাহলে আমরা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বলে যে গান গাই, সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা হবে না। আমি চাই আমি সগর্বে যেন বলতে পারি, এদেশ আমার গর্ব। এদেশের মাটি আমার সোনা। আমি করে যাই তার জন্ম বৃত্তান্ত’। মানুষটি হেঁটে চলে গেলেন এমন এক অপরিচিত সময়ে যখন তাকে প্রকাশ্যে স্যালুট জানানো হলো না। তার প্রস্থানে পুষ্প বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমিতো দেখছি, সেই সফেদ পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা দীর্ঘদেহী আমার বন্ধু কামাল লোহানী হেঁটে যাচ্ছেন, দুই পাশে শ্রদ্ধায় নতজানু বাংলাদেশ। লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি