বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় যে কজন মানুষ তাদের জীবনের সোনালী দিনগুলোতে রাজপথ কাঁপিয়েছেন, যে কজন গুণী ব্যক্তি এই রাষ্ট্রের প্রগতিশীল স্বপ্ন ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে তাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন, কামাল লোহানী তাদের মধ্যে এক অগ্রগণ্য বাতিঘর। পাকিস্তান সৃষ্টির লগ্ন থেকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন তারপর মহান মুক্তিযুদ্ধে কামাল লোহানী ছিলেন আপোসহীন এক ব্যক্তিত্ব।
স্বাধীনতার আন্দোলনে তার ভূমিকা কিংবদন্তীসম। শনিবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে রাজধানীর মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি পরলোক গমন করেন। তিনি সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় বিচরণ করেছেন অবলীলায়। স্বাধীন বাংলায় ও তার পূর্বে এই জাতির মানস গঠনে বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। কামাল লোহানী ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘দৈনিক পূর্বদেশ’, ‘দৈনিক বার্তা’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দু’বার যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি ছিলেন। ১৯৬২ সালে কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠন। তিনি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন চার বছর (২০১২ ডিসেম্বর – ২০১৬ ডিসেম্বর)। কামাল লোহানী নামে পরিচিত থাকলেও তার আসল নাম আবু নাইম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার খান মনতলা গ্রামে তার জন্ম হয়। ১৯৫২ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। পরে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই রাজনীতির হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নূরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন। সেই সময়ই তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন। পরের বছর আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে বন্দি ছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে যুক্ত হন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজার হাজার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিককর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হন। ষাটের দশকের শেষ ভাগে কামাল লোহানী যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী যুদ্ধে যোগ দেন। সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী। ১৯৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নতুন করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুই দফায় মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী। পাঁচ বছর ছিলেন ছায়ানটের সম্পাদক। তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টাও ছিলেন। তার মতো একজন মহান দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক নেতা এই দেশে বিরল।
তার শূন্যস্থান কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারালো এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুক্তবুদ্ধির চিন্তককে। তার প্রস্থান এই অসময়ে আসলেই একটি নক্ষত্রের মহাপ্রস্থান যেন। আমাদের আশার স্বপ্নের বাতিঘরগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এই হারানোর তালিকায় সর্বশেষ কামাল লোহানী আজ প্রয়াত হলেন। তার স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।